তিরমিযী হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন- পাঁচটি অবস্থার পূর্বে পাঁচটি অবস্থাকে গনীমত বলে গণ্য করবে। (১) বার্ধক্যের পূর্বে যৌবনকে। (২) অসুস্থতার পূর্বে সুস্থতাকে। (৩) অভাবের পূর্বে স্বচ্ছলতাকে। (৪) অধিক ব্যস্ততার পূর্বে অবসরকে। (৫) মৃত্যুর পূর্বে হায়াতকে। অর্থাৎ সৎকাজে অলসতা করো না, গোনাহের ব্যাপারে
আল্লাহকে ভয় করো। তোমার জীবন আর কতক্ষণ অবশিষ্টরয়েছে, তুমি কতক্ষণ সুস্থ থাকবে আর অবসর পাবে কিনা তুমি জানো না। তাই আল্লাহর সন্তুষ্টির কাজে নিজেকে
নিয়োজিত করো। আল্লাহর অসন্তুষ্টির কাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখো। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনেআল্লাহকে ভয় করো। তোমার জীবন আর কতক্ষণ অবশিষ্টরয়েছে, তুমি কতক্ষণ সুস্থ থাকবে আর অবসর পাবে কিনা তুমি জানো না। তাই আল্লাহর সন্তুষ্টির কাজে নিজেকে
মাসউদ রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু বর্ণনা করেছেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
কিয়ামতের দিন আদম সন্তানের দুই পা কোনো দিকে নড়াতে পারবে না, যতক্ষণ না তাকে পাঁচটি বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে। (১) পৃথিবীতে তাকে যে হায়াত দেয়া হয়েছিলো, সে হায়াত কোন্ পথে ব্যয় করা হয়েছে। (২) সে তার যৌবনকে কোন্ পথে ব্যয় করেছে। (৩) সম্পদ কোন্ পথে উপার্জন করেছে। (৪) সম্পদ কোন্ পথে ব্যয় করেছে। (৫) যে জ্ঞান তাকে দেয়া হয়েছিলো, তা কোন্ কাজে লাগিয়েছে। (তিরমিযী)
এই পাঁচটি প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব না দেয়া পর্যন্ত আখিরাতের ময়দানে কোনো মানুষের পক্ষে এক কদমও এদিক-ওদিক যাওয়া সম্ভব হবে না। আর যে পাঁচটি প্রশ্ন করা হবে, এই প্রশ্নের জবাবের মধ্যে একজন মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত গোটা জীবনকালের পূর্ণাঙ্গ চিত্র স্পষ্ট দেখা যাবে। প্রথম প্রশ্ন করা হবে, পৃথিবীতে তাকে যে হায়াত বা জীবনকাল দেয়া হয়েছিলো, এই জীবনকাল সে কিভাবে কোন্ পদ্ধতি অনুযায়ী বা কোন্ বিধান অনুসারে পরিচালিত করেছে? পৃথিবীতে একজন মানুষও কোনো ধরনের আইন-কানুন ও বিধান ব্যতীত নিজের জীবন পরিচালনা করতে পারে না। সন্তান যখন মাতৃগর্ভে আগমন করে, তখন সেই মা’কে পারিবারিক বা সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত কারণে কিছু না কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। সন্তান যখন মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়, তখনও কোনো না কোনো নিয়ম-কানুন মা’কে পালন করতে হয়। এরপর সেই সন্তানের প্রতিপালন ও শিক্ষার ক্ষেত্রেও নিয়ম-পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। এসব নিয়ম অনুসরণ করা ব্যতীত মানুষ চলতে পারে না।
এরপর সেই মানুষকে একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের অধীনে বাস করতে হয়। এখানেও তাকে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত আইন-কানুন মেনে চলতে হয়। সেই মানুষ যদি রাজনীতি করে, তাহলে তাকে একটি রাজনৈতিক দর্শন অনুসরণ করতে হয়। সে যদি কোনো দল করে, তাহলে সেই দলের আদর্শ তাকে মেনে চলতে হবে অথবা সমর্থন দিতে হবে। সে যদি সক্রিয়ভাবে কোনো দল না-ও করে, তাহলে দেশের নাগরিক হিসেবে তাকে অন্তত ভোট দেয়ার দায়িত্ব পালন করতে হয়। ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রেও তাকে একটি নিয়ম অনুসরণ করতে হয় এবং বিশেষ কোনো প্রার্থীকে ভোট দিতে হয়। পৃথিবীতে জীবিকা অর্জনের ব্যাপারে মানুষকে কোনো কোনো পেশা অবশ্যই গ্রহণ করতে হয় এবং সেই পেশাও কোনো না কোনো নিয়মের অধীন। সেই নিয়ম অনুসরণ করেই তাকে জীবিকা অর্জন করতে হয়। কোনো কারণবশতঃ কোনো মানুষকে যদি আইন-আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়, তাহলে সেখানে তাকে আইনের সিদ্ধান্ত মেনে নিতেই হবে। এভাবে করে প্রত্যেকটি মানুষকে পৃথিবীতে বিশেষ আইন-কানুন, বিধান, নিয়ম-পদ্ধতি মেনে নিয়েই জীবন পরিচালনা করতে হয়। আখিরাতের ময়দানে প্রথম প্রশ্ন এটাই হবে যে, সে যেসব নিয়ম-পদ্ধতি বা বিধানের অধীনে পৃথিবীতে জীবনকাল অতিবাহিত করেছে, সেই জীবনকাল কি সে মহান আল্লাহর বিধানের অধীনে অতিবাহিত করেছে- না মানুষের বানানো বিধানের অধীনে অতিবাহিত করেছে?
প্রশ্নের জবাব যদি এটা হয় যে, পৃথিবীতে আল্লাহ তা’য়ালা তাকে যে জীবনকাল দিয়েছিলেন, সে জীবনকাল আল্লাহর বিধানের অধীনে অতিবাহিত করেছে অথবা এমন দেশে সে বাস করতে বাধ্য হতো, যেখানে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়িত ছিল না, কিন্তু সে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করার জন্য আমরণ আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। তাহলে আশা করা যায়, মহান আল্লাহ তা’য়ালা সেই ব্যক্তির আমলনামা অনুসারে মুক্তির ফয়সালা গ্রহণ করবেন। আর যদি দেখা যায় যে, পৃথিবীর জীবনকাল সে অন্য মানুষের বানানো বিধান অনুসারে অতিবাহিত করেছে, আল্লাহর বিধান সম্পর্কে জানার চেষ্টাও করেনি, এই বিধান বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে আন্দোলন-সংগ্রামও করেনি এবং যারা করেছে, তাদের প্রতি সমর্থনও দেয়নি। বরং অন্য মানুষের বানানো মতবাদ-মতাদর্শ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তার জীবনকাল অতিবাহিত করেছে। তাহলে আল্লাহ তা’য়ালা সেই ব্যক্তির আমলনামা অনুসারে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
প্রথম প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব পাওয়া গেলে পরবর্তী চারটি প্রশ্নের আর প্রয়োজনীয়তা থাকে না। কিন্তু অন্য চারটি প্রশ্নের মাধ্যমে প্রত্যেকটি মানুষের দুর্বল দিক তুলে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় প্রশ্ন থাকবে যৌবন কাল সম্পর্কে। জানতে চাওয়া হবে, সে তার যৌবনকাল কোন্ পথে ব্যয় করেছে। কারণ যৌবনকাল মানব জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাল তথা স্বর্ণালী সময়। এ সময়ই মানুষের জীবন পরিপূর্ণ হয়, দৈহিক যাবতীয় বৃত্তিনিচয় বিকশিত হয়, স্বভাবগত কামনা-বাসনা অদম্য হয়ে ওঠে, উৎসাহ, উদ্দীপনা শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত হয়, ক্লান্তিহীন কর্ম ক্ষমতা দেহ যন্ত্রকে সচল রাখে এবং যাবতীয় বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করার দুর্বার সাহস পূর্ণ অবয়বে বিকশিত হয়। এই যৌবনকালকে মানুষ আল্লাহর বিধানের অধীনে ব্যবহার করেছে না মনের অদম্য কামনা-বাসনা অনুসারে অথবা আল্লাহদ্রোহী নেতা নেত্রীদের নির্দেশ অনুসারে পরিচালিত করেছে, এর জবাব জানতে চাওয়া হবে।
এরপর প্রশ্ন করা হবে, পৃথিবীতে সম্পদ সে কোন্ পথে উপার্জন করেছে? পৃথিবীতে জীবন ধারনের জন্য অর্থ সম্পদ একান্ত প্রয়োজন এবং এসব উপার্জন করাও মানুষের স্বভাবগত চাহিদা। জানতে চাওয়া হবে, এই অর্থ-সম্পদ সে কিভাবে, কোন্ পথে উপার্জন করেছে। অর্থ-সম্পদ উপার্জনের ক্ষেত্রে আদালতে আখিরাতে জবাবদিহির অনুভূতি তার মধ্যে ছিলো কিনা। কাউকে ঠকিয়ে, সমাজ ও দেশের ক্ষতি করে সে অর্থ-সম্পদ উপার্জন করেছে কিনা। সুদ-ঘুষ বা অবৈধ কোনো ব্যবসার মাধ্যমে অথবা অন্যকে শোষণ করে উপার্জন করেছে কিনা। এসব বিষয়ে মানুষকে চুলচেরা হিসাব দিতে হবে।
এরপরে আসবে ব্যয়ের প্রশ্ন। যে অর্থ সম্পদ সে উপার্জন করেছিলো, তা সে কোন্ পথে ব্যয় করেছে? তার অর্জিত ধন-সম্পদে নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশী ও অভাবীদের যে অধিকার ছিলো, তা সে আদায় করেছে কিনা। আল্লাহ তা’য়ালা যে জীবন ব্যবস্থা দিয়েছেন, তা প্রতিষ্ঠিত করার কাজে সম্পদের কতটুকু অংশ সে ব্যয় করেছে? অথবা আল্লাহর দেয়া এই অর্থ-সম্পদ সে আল্লাহর বিধানের বিপরীত বিধান প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যবহার করেছে কিনা। এই সম্পদ সে নিছক ভোগ-বিলাস বা পাপাচারের পথে ব্যয় করেছে কিনা। এই সম্পদ সে প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা অর্জনের কাজে বা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার কাজে ব্যবহার করেছে কিনা। এসব অর্থ-সম্পদ মানুষের চরিত্র বিনষ্ট করার কাজে সে ব্যবহার করেছে কিনা, এসব প্রশ্নের জবাব পুক্মখানুপুক্মখরূপে দিতে হবে।
সর্বশেষ প্রশ্ন থাকবে, যে জ্ঞান তাকে দেয়া হয়েছিলো, তা কোন্ কাজে লাগিয়েছে। মানুষের পৃথিবীর জীবনকালে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন একান্ত অনুগ্রহ করে যে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ তাকে দিয়েছিলেন, যতটুকু জ্ঞান-বিবেক, বুদ্ধি তাকে দিয়েছিলেন, শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের যে সুযোগ তাকে দিয়েছিলেন, সেই জ্ঞান, শিক্ষা, বিবেক-বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা সে কোন্ কাজে ব্যবহার করেছে? এসব কিছু সে পৃথিবীতে মহান আল্লাহর বিধানের বিপরীত পথে ব্যবহার করেছে- না আল্লাহ তা’য়ালার সন্তোষ অর্জনের পথে ব্যবহার করেছে?
এই পাঁচটি প্রশ্নের যথাযথ জবাব দিতে হবে এবং সন্তোষজনক জবাবের ওপর নির্ভর করবে মানুষের মুক্তি ও পুরস্কার। আর যথাযথ জবাব দিতে ব্যর্থ হলে, তাকে ভোগ করতে হবে অবর্ণনীয় শাস্তি এবং তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। এই পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষকেই উল্লেখিত প্রশ্নের জবাব দিতেই হবে, কারণ প্রত্যেকেই নিজের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। সে যাকিছু পৃথিবীতে করছে, এর দায়-দায়িত্ব একান্তভাবেই তার নিজের ওপর বর্তাবে এবং তাকে জবাবদিহি করতে হবে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন-
ভালো করে জেনে রাখো, তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, আর প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন-
যে ব্যক্তি তার রব-এর মহাবিচারের সম্মুখে উপস্থিতিকে ভয় করলো এবং নিজের সত্তাকে কু-প্রবৃত্তির তাড়না থেকে বিরত রাখলো তার ঠিকানা হলো জান্নাত।.
পক্ষান্তরে যারা মৃত্যুর পরের জীবনকে অবিশ্বাস, অবহেলা ও অবজ্ঞা করে পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী জীবনকে একমাত্র জীবন বলে ভোগ-বিলাসে মেতে থাকবে, ন্যায় অন্যায়বোধ বিসর্জন দেবে, ইনসাফকে উপেক্ষা করে চলবে, আল্লাহর দাসত্ব ত্যাগ করে শিরক্-এ লিপ্ত হবে, হারাম-হালালবোধ বিস্মৃত হয়ে অন্যের অধিকার হরণ করে সম্পদের স্তুপ গড়বে, মানুষের সম্মান-মর্যাদাবোধের প্রতি আঘাত হানবে, জুলুম-অত্যাচার করবে তথা পরকালীন জীবনের তুলনায় দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দিবে, তারা অবশ্যই মৃত্যুর পরের জীবনে এক ভয়াবহ বিপদের সম্মুখিন হবে। এসব লোকদেরকে আখিরাতের ময়দানে মহান আল্লাহ শুনিয়ে দেবেন-
তোমাদের (জন্য বরাদ্দকৃত) নে’মাতসমূহ তোমরা দুনিয়ার জীবনে শেষ করে এসেছো, আর সবকিছু তোমাদের ইচ্ছা মতোই ভোগ করেছো। আজ তোমরা অপমানকর শাস্তি পাচ্ছো এ জন্য যে, তোমরা দুনিয়ার যমীনে অহঙ্কার করতে আর এ জন্য যে, তোমরা অপরাধ করছিলে। (কোরআন)
কিয়ামতের দিন আদম সন্তানের দুই পা কোনো দিকে নড়াতে পারবে না, যতক্ষণ না তাকে পাঁচটি বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে। (১) পৃথিবীতে তাকে যে হায়াত দেয়া হয়েছিলো, সে হায়াত কোন্ পথে ব্যয় করা হয়েছে। (২) সে তার যৌবনকে কোন্ পথে ব্যয় করেছে। (৩) সম্পদ কোন্ পথে উপার্জন করেছে। (৪) সম্পদ কোন্ পথে ব্যয় করেছে। (৫) যে জ্ঞান তাকে দেয়া হয়েছিলো, তা কোন্ কাজে লাগিয়েছে। (তিরমিযী)
এই পাঁচটি প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব না দেয়া পর্যন্ত আখিরাতের ময়দানে কোনো মানুষের পক্ষে এক কদমও এদিক-ওদিক যাওয়া সম্ভব হবে না। আর যে পাঁচটি প্রশ্ন করা হবে, এই প্রশ্নের জবাবের মধ্যে একজন মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত গোটা জীবনকালের পূর্ণাঙ্গ চিত্র স্পষ্ট দেখা যাবে। প্রথম প্রশ্ন করা হবে, পৃথিবীতে তাকে যে হায়াত বা জীবনকাল দেয়া হয়েছিলো, এই জীবনকাল সে কিভাবে কোন্ পদ্ধতি অনুযায়ী বা কোন্ বিধান অনুসারে পরিচালিত করেছে? পৃথিবীতে একজন মানুষও কোনো ধরনের আইন-কানুন ও বিধান ব্যতীত নিজের জীবন পরিচালনা করতে পারে না। সন্তান যখন মাতৃগর্ভে আগমন করে, তখন সেই মা’কে পারিবারিক বা সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত কারণে কিছু না কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। সন্তান যখন মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়, তখনও কোনো না কোনো নিয়ম-কানুন মা’কে পালন করতে হয়। এরপর সেই সন্তানের প্রতিপালন ও শিক্ষার ক্ষেত্রেও নিয়ম-পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। এসব নিয়ম অনুসরণ করা ব্যতীত মানুষ চলতে পারে না।
এরপর সেই মানুষকে একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের অধীনে বাস করতে হয়। এখানেও তাকে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত আইন-কানুন মেনে চলতে হয়। সেই মানুষ যদি রাজনীতি করে, তাহলে তাকে একটি রাজনৈতিক দর্শন অনুসরণ করতে হয়। সে যদি কোনো দল করে, তাহলে সেই দলের আদর্শ তাকে মেনে চলতে হবে অথবা সমর্থন দিতে হবে। সে যদি সক্রিয়ভাবে কোনো দল না-ও করে, তাহলে দেশের নাগরিক হিসেবে তাকে অন্তত ভোট দেয়ার দায়িত্ব পালন করতে হয়। ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রেও তাকে একটি নিয়ম অনুসরণ করতে হয় এবং বিশেষ কোনো প্রার্থীকে ভোট দিতে হয়। পৃথিবীতে জীবিকা অর্জনের ব্যাপারে মানুষকে কোনো কোনো পেশা অবশ্যই গ্রহণ করতে হয় এবং সেই পেশাও কোনো না কোনো নিয়মের অধীন। সেই নিয়ম অনুসরণ করেই তাকে জীবিকা অর্জন করতে হয়। কোনো কারণবশতঃ কোনো মানুষকে যদি আইন-আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়, তাহলে সেখানে তাকে আইনের সিদ্ধান্ত মেনে নিতেই হবে। এভাবে করে প্রত্যেকটি মানুষকে পৃথিবীতে বিশেষ আইন-কানুন, বিধান, নিয়ম-পদ্ধতি মেনে নিয়েই জীবন পরিচালনা করতে হয়। আখিরাতের ময়দানে প্রথম প্রশ্ন এটাই হবে যে, সে যেসব নিয়ম-পদ্ধতি বা বিধানের অধীনে পৃথিবীতে জীবনকাল অতিবাহিত করেছে, সেই জীবনকাল কি সে মহান আল্লাহর বিধানের অধীনে অতিবাহিত করেছে- না মানুষের বানানো বিধানের অধীনে অতিবাহিত করেছে?
প্রশ্নের জবাব যদি এটা হয় যে, পৃথিবীতে আল্লাহ তা’য়ালা তাকে যে জীবনকাল দিয়েছিলেন, সে জীবনকাল আল্লাহর বিধানের অধীনে অতিবাহিত করেছে অথবা এমন দেশে সে বাস করতে বাধ্য হতো, যেখানে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়িত ছিল না, কিন্তু সে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করার জন্য আমরণ আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। তাহলে আশা করা যায়, মহান আল্লাহ তা’য়ালা সেই ব্যক্তির আমলনামা অনুসারে মুক্তির ফয়সালা গ্রহণ করবেন। আর যদি দেখা যায় যে, পৃথিবীর জীবনকাল সে অন্য মানুষের বানানো বিধান অনুসারে অতিবাহিত করেছে, আল্লাহর বিধান সম্পর্কে জানার চেষ্টাও করেনি, এই বিধান বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে আন্দোলন-সংগ্রামও করেনি এবং যারা করেছে, তাদের প্রতি সমর্থনও দেয়নি। বরং অন্য মানুষের বানানো মতবাদ-মতাদর্শ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তার জীবনকাল অতিবাহিত করেছে। তাহলে আল্লাহ তা’য়ালা সেই ব্যক্তির আমলনামা অনুসারে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
প্রথম প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব পাওয়া গেলে পরবর্তী চারটি প্রশ্নের আর প্রয়োজনীয়তা থাকে না। কিন্তু অন্য চারটি প্রশ্নের মাধ্যমে প্রত্যেকটি মানুষের দুর্বল দিক তুলে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় প্রশ্ন থাকবে যৌবন কাল সম্পর্কে। জানতে চাওয়া হবে, সে তার যৌবনকাল কোন্ পথে ব্যয় করেছে। কারণ যৌবনকাল মানব জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাল তথা স্বর্ণালী সময়। এ সময়ই মানুষের জীবন পরিপূর্ণ হয়, দৈহিক যাবতীয় বৃত্তিনিচয় বিকশিত হয়, স্বভাবগত কামনা-বাসনা অদম্য হয়ে ওঠে, উৎসাহ, উদ্দীপনা শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত হয়, ক্লান্তিহীন কর্ম ক্ষমতা দেহ যন্ত্রকে সচল রাখে এবং যাবতীয় বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করার দুর্বার সাহস পূর্ণ অবয়বে বিকশিত হয়। এই যৌবনকালকে মানুষ আল্লাহর বিধানের অধীনে ব্যবহার করেছে না মনের অদম্য কামনা-বাসনা অনুসারে অথবা আল্লাহদ্রোহী নেতা নেত্রীদের নির্দেশ অনুসারে পরিচালিত করেছে, এর জবাব জানতে চাওয়া হবে।
এরপর প্রশ্ন করা হবে, পৃথিবীতে সম্পদ সে কোন্ পথে উপার্জন করেছে? পৃথিবীতে জীবন ধারনের জন্য অর্থ সম্পদ একান্ত প্রয়োজন এবং এসব উপার্জন করাও মানুষের স্বভাবগত চাহিদা। জানতে চাওয়া হবে, এই অর্থ-সম্পদ সে কিভাবে, কোন্ পথে উপার্জন করেছে। অর্থ-সম্পদ উপার্জনের ক্ষেত্রে আদালতে আখিরাতে জবাবদিহির অনুভূতি তার মধ্যে ছিলো কিনা। কাউকে ঠকিয়ে, সমাজ ও দেশের ক্ষতি করে সে অর্থ-সম্পদ উপার্জন করেছে কিনা। সুদ-ঘুষ বা অবৈধ কোনো ব্যবসার মাধ্যমে অথবা অন্যকে শোষণ করে উপার্জন করেছে কিনা। এসব বিষয়ে মানুষকে চুলচেরা হিসাব দিতে হবে।
এরপরে আসবে ব্যয়ের প্রশ্ন। যে অর্থ সম্পদ সে উপার্জন করেছিলো, তা সে কোন্ পথে ব্যয় করেছে? তার অর্জিত ধন-সম্পদে নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশী ও অভাবীদের যে অধিকার ছিলো, তা সে আদায় করেছে কিনা। আল্লাহ তা’য়ালা যে জীবন ব্যবস্থা দিয়েছেন, তা প্রতিষ্ঠিত করার কাজে সম্পদের কতটুকু অংশ সে ব্যয় করেছে? অথবা আল্লাহর দেয়া এই অর্থ-সম্পদ সে আল্লাহর বিধানের বিপরীত বিধান প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যবহার করেছে কিনা। এই সম্পদ সে নিছক ভোগ-বিলাস বা পাপাচারের পথে ব্যয় করেছে কিনা। এই সম্পদ সে প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা অর্জনের কাজে বা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার কাজে ব্যবহার করেছে কিনা। এসব অর্থ-সম্পদ মানুষের চরিত্র বিনষ্ট করার কাজে সে ব্যবহার করেছে কিনা, এসব প্রশ্নের জবাব পুক্মখানুপুক্মখরূপে দিতে হবে।
সর্বশেষ প্রশ্ন থাকবে, যে জ্ঞান তাকে দেয়া হয়েছিলো, তা কোন্ কাজে লাগিয়েছে। মানুষের পৃথিবীর জীবনকালে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন একান্ত অনুগ্রহ করে যে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ তাকে দিয়েছিলেন, যতটুকু জ্ঞান-বিবেক, বুদ্ধি তাকে দিয়েছিলেন, শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের যে সুযোগ তাকে দিয়েছিলেন, সেই জ্ঞান, শিক্ষা, বিবেক-বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা সে কোন্ কাজে ব্যবহার করেছে? এসব কিছু সে পৃথিবীতে মহান আল্লাহর বিধানের বিপরীত পথে ব্যবহার করেছে- না আল্লাহ তা’য়ালার সন্তোষ অর্জনের পথে ব্যবহার করেছে?
এই পাঁচটি প্রশ্নের যথাযথ জবাব দিতে হবে এবং সন্তোষজনক জবাবের ওপর নির্ভর করবে মানুষের মুক্তি ও পুরস্কার। আর যথাযথ জবাব দিতে ব্যর্থ হলে, তাকে ভোগ করতে হবে অবর্ণনীয় শাস্তি এবং তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। এই পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষকেই উল্লেখিত প্রশ্নের জবাব দিতেই হবে, কারণ প্রত্যেকেই নিজের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। সে যাকিছু পৃথিবীতে করছে, এর দায়-দায়িত্ব একান্তভাবেই তার নিজের ওপর বর্তাবে এবং তাকে জবাবদিহি করতে হবে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন-
ভালো করে জেনে রাখো, তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, আর প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন-
যে ব্যক্তি তার রব-এর মহাবিচারের সম্মুখে উপস্থিতিকে ভয় করলো এবং নিজের সত্তাকে কু-প্রবৃত্তির তাড়না থেকে বিরত রাখলো তার ঠিকানা হলো জান্নাত।.
পক্ষান্তরে যারা মৃত্যুর পরের জীবনকে অবিশ্বাস, অবহেলা ও অবজ্ঞা করে পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী জীবনকে একমাত্র জীবন বলে ভোগ-বিলাসে মেতে থাকবে, ন্যায় অন্যায়বোধ বিসর্জন দেবে, ইনসাফকে উপেক্ষা করে চলবে, আল্লাহর দাসত্ব ত্যাগ করে শিরক্-এ লিপ্ত হবে, হারাম-হালালবোধ বিস্মৃত হয়ে অন্যের অধিকার হরণ করে সম্পদের স্তুপ গড়বে, মানুষের সম্মান-মর্যাদাবোধের প্রতি আঘাত হানবে, জুলুম-অত্যাচার করবে তথা পরকালীন জীবনের তুলনায় দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দিবে, তারা অবশ্যই মৃত্যুর পরের জীবনে এক ভয়াবহ বিপদের সম্মুখিন হবে। এসব লোকদেরকে আখিরাতের ময়দানে মহান আল্লাহ শুনিয়ে দেবেন-
তোমাদের (জন্য বরাদ্দকৃত) নে’মাতসমূহ তোমরা দুনিয়ার জীবনে শেষ করে এসেছো, আর সবকিছু তোমাদের ইচ্ছা মতোই ভোগ করেছো। আজ তোমরা অপমানকর শাস্তি পাচ্ছো এ জন্য যে, তোমরা দুনিয়ার যমীনে অহঙ্কার করতে আর এ জন্য যে, তোমরা অপরাধ করছিলে। (কোরআন)