হজে যাচ্ছেন, আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা করুন-হে আল্লাহ! আমার হজকে সহজ করো, কবুল করো-দেখবেন, আপনার সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। হজের দীর্ঘ সফরে ধৈর্য হারাবেন না। সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মানসিকতা রাখবেন, তাহলে অল্পতেই বিচলিত হবেন না। হজের প্রস্তুতিপর্বে-পিলগ্রিম পাস (হজ পাসপোর্ট) তৈরি করা
, বিমানের টিকিট সংগ্রহ ও তারিখ নিশ্চিত (কনফার্ম) করা, প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করা, ম্যানিনজাইটিস টিকা বা অন্যান্য ভ্যাকসিন দেওয়া (অনেকে দালালের মাধ্যমে ১০০ বা ২০০ টাকায় টিকা দেওয়ার সনদ সংগ্রহ করেন, এটা করবেন না)-হজের এসব নিয়ম জানার জন্য একাধিক বই পড়তে পারেন। অথবা যাঁরা পড়তে পারেন না, তাঁরা হজে যাঁরা গেছেন, তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করুন। হজের কোনো বিষয়ে বিভিন্নতা দেখলে ঝগড়া করবেন না। আপনি যেই আলেমের ইলম ও তাকওয়ার ওপর আস্থা রাখেন, তাঁর সমাধান অনুযায়ী আমল করবেন, তবে সেমতে আমল করার জন্য অন্য কাউকে বাধ্য করবেন না। আর হজে যাওয়ার জন্য পরিচিত অথবা এলাকার দলনেতার (গ্রুপ লিডার) সঙ্গে আলাপ করতে পারেন।
বাংলাদেশ থেকে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়-দুভাবে হজ করতে যাওয়া যায়।
হজের জন্য প্রয়োজনীয় মালপত্র সংগ্রহ করা দরকার, যেমন-১· পিলগ্রিম পাস, টিকিট, ডলার কেনা, ২· পিলগ্রিম পাস, ভিসা, টাকা রাখার জন্য গলায় ঝোলানো ছোট ব্যাগ, ৩· ইহরামের কাপড় কমপক্ষে দুই সেট (প্রতি সেটে শরীরের নিচের অংশে পরার জন্য আড়াই হাত বহরের আড়াই গজ এক টুকরা কাপড় আর গায়ের চাদরের জন্য একই বহরের তিন গজ কাপড়। ইহরামের কাপড় হবে সাদা। সুতি হলে ভালো হয়), ৪· নরম ফিতাওয়ালা স্পঞ্জের স্যান্ডেল, ৫· ইহরাম পরার কাজে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন হলে কটিবন্ধনী (বেল্ট), ৬· গামছা, তোয়ালে, ৭· লুঙ্গি, গেঞ্জি, পায়জামা, পাঞ্জাবি-আপনি যে পোশাক পরবেন, ৮· সাবান, পেস্ট, ব্রাশ, মিসওয়াক, ৯· নখ কাটার যন্ত্র, সুই-সুতা, ১০· থালা, বাটি, গ্লাস, ১১· হজের বই, কোরআন শরিফ, ধর্মীয় পুস্তক, ১২· কাগজ-কলম, ১৩· শীতের কাপড় (মদিনায় ঠান্ডা পড়ে বেশি), ১৪· প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, চশমা ব্যবহার করলে অতিরিক্ত একটি চশমা (ভিড় বা অন্য কোনো কারণে ভেঙে গেলে ব্যবহারের জন্য), ১৫· বাংলাদেশি টাকা (দেশে ফেরার পর বিমানবন্দর থেকে বাড়ি ফেরার জন্য), ১৬· নারীদের জন্য বোরকা, ১৭· মালপত্র নেওয়ার জন্য ব্যাগ অথবা সুøটকেস (তালাচাবিসহ); ব্যাগের ওপর ইংরেজিতে নিজের নাম-ঠিকানা, ফোন নম্বর লিখতে হবে। এ ছাড়া আপনার প্রয়োজনীয় মালপত্র সঙ্গে নেবেন।
ঢাকার আশকোনায় অবস্থিত হাজি ক্যাম্পে টিকা দেওয়া, হজের প্রশিক্ষণ, বৈদেশিক মুদ্রা কেনাসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিস পাওয়া যায়।
হজ করতে যাচ্ছেন-যাত্রার শুরুতে নিজেকে এমনভাবে তৈরি করে নিন, যেন দেহ-মনে কোনো কষ্ট না থাকে। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে হজ হলো দৈহিক ও আর্থিক ইবাদত এবং শ্রমসাধ্য ব্যাপার।
আপনার মালপত্র হালকা রাখুন, কারণ আপনার মাল আপনাকেই বহন করতে হবে। আপনার সঙ্গীদের সম্মান করুন, তাঁদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকৃত ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আপনার দলে (গ্রুপে) দুর্বল বয়স্কদের প্রতি খেয়াল রাখবেন। সৌদি আরবে গিয়ে বিভিন্ন ওয়াক্তের নামাজ হারাম শরিফে জামাতে আদায় করার চেষ্টা করবেন (অনেকে বাসায় অথবা মহল্লার মসজিদে নামাজ আদায় করেন)। যাত্রার শুরুতে ভালো সফরসঙ্গী খুঁজে নেবেন, যাতে নামাজ পড়তে ও বাসায় চলাফেরায় একে অন্যের সাহায্য নিতে পারেন।
আপনি হজের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে যাচ্ছেন; সেখানকার মানুষ আরবি ভাষায় কথা বলে, রাস্তাঘাট আপনার অচেনা। কিন্তু হজযাত্রীদের খেদমত বা সেবা করার জন্য সৌদি আরব ও বাংলাদেশ সরকার নানা রকম ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।
ঢাকার হাজি ক্যাম্প
হাজি ক্যাম্পে যত দিন অবস্থান করবেন, আপনার মালপত্র খেয়াল রাখবেন। একদল সুযোগসন্ধানী লোক মালপত্র চুরি করে।
কোনো টিকা বা ভ্যাকসিন নেওয়া বাকি থাকলে অবশ্যই তা নিয়ে নিন।
বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে নিন।
জেনে নিন আপনার গন্তব্য ঢাকা থেকে মক্কায়, নাকি মদিনায়। যদি মদিনায় হয়, তাহলে এখন ইহরাম বাঁধা নয়; যখন মদিনা থেকে মক্কায় যাবেন, তখন ইহরাম পরতে হবে। বেশির ভাগ হজযাত্রী আগে মক্কা যান। যদি মক্কা যেতে হয়, তাহলে ঢাকা থেকে বিমানে ওঠার আগে ইহরাম বাঁধা ভালো। কারণ, জেদ্দা পৌঁছানোর আগেই ইয়ালামলাম মিকাত বা ইহরাম বাঁধার নির্দিষ্ট স্থান। বিমানে যদিও ইহরাম বাঁধার কথা বলা হয়, কিন্তু ওই সময় অনেকে ঘুমিয়ে থাকেন; আর বিমানে পোশাক পরিবর্তন করাটাও দৃষ্টিকটু। বিনা ইহরামে মিকাত পার হলে এ জন্য দম বা কাফফারা দিতে হবে। তদুপরি গুনাহ হবে।
ইহরাম ছাড়া মিকাত অতিক্রম নিষিদ্ধ। হজ বা উমরাহ পালনকারী ব্যক্তির জন্য বিনা ইহরামে যে স্থান অতিক্রম করা জায়েজ নয়, তা-ই হলো মিকাত। বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘরের সম্মানার্থে প্রত্যেককে নিজ নিজ মিকাত থেকে ইহরাম বাঁধতে হয় (মিকাত পাঁচটি-১· যুল হুলায়ফা বা বীরে আলীঃ মদিনাবাসী মক্কায় প্রবেশের মিকাত, ২· ইয়ালামলামঃ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থেকে জেদ্দা হয়ে মক্কা প্রবেশের মিকাত। ৩· আল-জুহফাঃ সিরিয়া, মিসর এবং সেদিক থেকে আগতদের জন্য মিকাত। ৪· কারনুল মানাজিল বা আসসায়েল আল-কাবিরঃ নাজদ থেকে আগতদের জন্য মিকাত এবং ৫· যাতু ইর্কঃ ইরাক থেকে আগতদের জন্য মিকাত)।
ঢাকা বিমানবন্দর
উড্ডয়নের সময় অনুযায়ী বিমানবন্দরে পৌঁছান। আপনার নাম-ঠিকানা লেখা ব্যাগ বা সুটকেসে কোনো পচনশীল খাবার রাখবেন না। বিমানবন্দরে লাগেজে যে মাল দেবেন, তা ঠিকমতো বাঁধা হয়েছে কি না, দেখে নেবেন। বিমানের কাউন্টারে মাল রেখে এর টোকেন দিলে তা যত্ন করে রাখবেন। কারণ, জেদ্দা বিমানবন্দরে ওই টোকেন দেখালে সেই ব্যাগ আপনাকে ফেরত দেবে। ইমিগ্রেশন, চেকিংয়ের পর নিজ মালপত্র যত্নে রাখুন।
বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া পরিচয়পত্র, পিলগ্রিম পাস, বিমানের টিকিট, টিকা দেওয়ার কার্ড, অন্য কাগজপত্র, টাকা, বিমানে পড়ার জন্য ধর্মীয় বই ইত্যাদি গলায় ঝোলানোর ব্যাগে যত্নে রাখুন।
সময়মতো বিমানে উঠে নির্ধারিত আসনে বসুন।
জেদ্দা বিমানবন্দর
মোয়াল্লেমের গাড়ি আপনাকে জেদ্দা থেকে মক্কায় যে বাড়িতে থাকবেন, সেখানে নামিয়ে দেবে। মোয়াল্লেমের নম্বর (আরবিতে লেখা) কব্জি বেল্ট দেওয়া হবে, তা হাতে পরে নেবেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া পরিচয়পত্র (যাতে পিলগ্রিম পাস নম্বর, নাম, ট্রাভেল এজেন্টের নাম ইত্যাদি থাকবে) গলায় ঝোলাবেন।
জেদ্দা থেকে মক্কায় পেঁৗছাতে দুই ঘণ্টা সময় লাগবে। চলার পথে তালবিয়া পড়ুন (লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক···)।
মক্কায় পৌঁছে
মক্কায় পৌঁছে আপনার থাকার জায়গায় মালপত্র রেখে ক্লান্ত থাকলে বিশ্রাম করুন। আর যদি নামাজের ওয়াক্ত হয়, নামাজ আদায় করুন। বিশ্রাম শেষে দলবদ্ধভাবে উমরাহর নিয়ত করে থাকলে উমরাহ পালন করুন।
মসজিদুল হারামে (কাবা শরিফ) অনেকগুলো প্রবেশপথ আছে; সব কটি দেখতে একই রকম। কিন্তু প্রতিটি প্রবেশপথে আরবি ও ইংরেজিতে ১, ২, ৩ নম্বর ও প্রবেশপথের নাম আছে, যেমন-বাদশা আবদুল আজিজ প্রবেশপথ। আপনি আগে থেকে ঠিক করবেন, কোন প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকবেন বা বের হবেন। আপনার সফরসঙ্গীকেও স্থান চিনিয়ে দিন। তিনি যদি হারিয়ে যান, তাহলে নির্দিষ্ট নম্বর গেটের সামনে থাকবেন। এতে ভেতরে ভিড়ে হারিয়ে গেলেও নির্দিষ্ট স্থানে এসে সঙ্গীকে খুঁজে পাবেন।
কাবা শরিফে স্যান্ডেল রাখার ক্ষেত্রে খুব সতর্ক থাকবেন, নির্দিষ্ট স্থানে জুতা রাখার জায়গায় রাখুন। এখানে-সেখানে জুতা রাখলে পরে আর খঁুজে পাবেন না। প্রতিটি জুতা রাখার র্যাকেও নম্বর দেওয়া আছে। এই নম্বর মনে রাখুন।
উমরাহর নিয়মকানুন আগে জেনে নেবেন, যেমন-সাতবার তাওয়াফ করা, জমজমের পানি পান করা, নামাজ আদায় করা, সাঈ করা (সাফা-মারওয়া পাহাড়ে দৌড়ানো-যদিও মসৃণ পথ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত), মাথা মুন্ডানো অথবা চুল ছোট করা-এসব কাজ ধারাবাহিকভাবে করা। ওয়াক্তীয় নামাজের সময় হলে যতটুকু হয়েছে ওই সময় নামাজ পড়ে আবার বাকিটুকু শেষ করা।
কাবা শরিফ
কাবা শরিফে প্রবেশ করার সময় বিসমিল্লাহ ও দরুদ শরিফ পড়ার পর আল্লাহুম মাফ তাহলি আব-ওয়া-বা রাহমাতিকা পড়বেন। মসজিদুল হারামে কোনো নারীর পাশে অথবা তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করা উচিত নয়।
কোনো দরজার সামনে নামাজ পড়া ঠিক নয়, এতে পথচারীর কষ্ট হয়।
হাজরে আসওয়াদে চুমু দেওয়া সুন্নত। তবে ভিড়ের কারণে না পারলে দূর থেকে চুমুর ইশারা করলেই চলবে। ভিড়ে অন্যকে কষ্ট দেওয়া যাবে না।
উমরাহ পালন ও হজ
উমরাহ
হিল (হারামের সীমানার বাইরে মিকাতের ভেতরের স্থান) থেকে অথবা মিকাত থেকে ইহরাম বেঁধে বায়তুল্লাহ শরিফ তাওয়াফ করা, সাফা-মারওয়া সাঈ করা এবং মাথার চুল ফেলে দেওয়া বা ছোট করাকে উমরাহ বলে।
হজ তিন প্রকার-তামাত্তু, কিরান ও ইফরাদ।
হজে তামাত্তু
হজের মাসসমূহে (শাওয়াল, জিলকদ, জিলহজ) উমরাহর নিয়তে ইহরাম করে, উমরাহ পালন করে, পরে হজের নিয়ত করে হজ পালন করাকে হজে তামাত্তু বলে।
হজে কিরান
হজের মাসসমূহে একই সঙ্গে হজ ও উমরাহ পালনের নিয়তে ইহরাম করে উমরাহ ও হজ করাকে হজে কিরান বলে।
হজে ইফরাদ
শুধু হজ পালনের উদ্দেশ্যে ইহরাম বেঁধে হজ সম্পাদনকে হজে ইফরাদ বলে।
তামাত্তু হজের নিয়ম
১· উমরাহর ইহরাম (ফরজ)
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সেরে গোসল বা অজু করে নিন।
মিকাত অতিক্রমের আগেই সেলাইবিহীন একটি সাদা কাপড় পরিধান করুন, আরেকটি গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ইহরামের নিয়তে দুই রাকাত নামাজ পড়ে নিন।
শুধু উমরাহর নিয়ত করে এক বা তিনবার তালবিয়া পড়ে নিন।
তালবিয়া হলো-লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা ওয়ান নিমাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক।
২· উমরার তাওয়াফ (ফরজ)
অজুর সঙ্গে ইজতিবাসহ তাওয়াফ করুন। ইহরামের চাদরকে ডান বগলের নিচের দিক থেকে পেঁচিয়ে এনে বাঁ কাঁধের ওপর রাখাকে ইজতিবা বলে।
হাজরে আসওয়াদকে সামনে রেখে তার বরাবর ডান পাশে দাঁড়ান (২০০৬ সাল থেকে মেঝেতে সাদা মার্বেল পাথর আর ডান পাশে সবুজ বাতি)। তারপর দাঁড়িয়ে তাওয়াফের নিয়ত করুন। তারপর ডানে গিয়ে এমনভাবে দাঁড়াবেন, যেন হাজরে আসওয়াদ পুরোপুরি আপনার সামনে থাকে। এরপর দুই হাত কাঁধ পর্যন্ত তুলে বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর, লা ইলাহা ইল্লাল লা-হু ওয়া লিল্লাহিল হামদ, ওয়াস সালাতু ওয়াস-সালামু আলা রাসুলিল্লাহ পড়ুন। পরে হাত ছেড়ে দিন এবং হাজরে আসওয়াদের দিকে হাত দিয়ে ইশারা করে হাতের তালুতে চুমু খেয়ে ডান দিকে চলতে থাকুন, যাতে পবিত্র কাবাঘর পূর্ণ বাঁয়ে থাকে। পুরুষের জন্য প্রথম তিন চক্করে রমল করা সুন্নত । রমল অর্থ বীরের মতো বুক ফুলিয়ে কাঁধ দুলিয়ে ঘন ঘন কদম রেখে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলা।
রুকনে ইয়ামানিকে সম্ভব হলে শুধু হাতে স্পর্শ করুন। রুকনে ইয়ামানিতে এলে রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়াকিনা আযাবান্নার, ওয়াদখিলনাল জান্নাতা মাআল আবরার, ইয়া আযিযু ইয়া গাফফার, ইয়া রাব্বাল আলামিন বলুন। চুমু খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। অতঃপর হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত এসে চক্কর পুরো করুন।
পুনরায় হাজরে আসওয়াদ বরাবর দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে হাতের তালুতে চুমু খেয়ে দ্বিতীয় চক্কর শুরু করুন। এভাবে সাত চক্করে তাওয়াফ শেষ করুন।
হাতে সাত দানার তসবি অথবা গণনাযন্ত্র রাখতে পারেন । তাহলে সাত চক্কর ভুল হবে না।
৩· তাওয়াফের দুই রাকাত নামাজ (ওয়াজিব)
মাকামে ইবরাহিমের পেছনে বা হারামের যেকোনো স্থানে তাওয়াফের নিয়তে (মাকরুহ সময় ছাড়া) দুই রাকাত নামাজ পড়ে দোয়া করুন। মনে রাখবেন, এটা দোয়া কবুলের সময়।
৪· উমরাহর সাঈ (ওয়াজিব)
সাফা পাহাড়ের কিছুটা ওপরে উঠে (এখন আর পাহাড় নেই, মেঝেতে মার্বেল পাথর, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত) কাবা শরিফের দিকে মুখ করে সাঈ-এর নিয়ত করে, দোয়ার মতো করে হাত তুলে তিনবার তাকবির বলে দোয়া করুন। তারপর মারওয়ার দিকে রওনা হয়ে দুই সবুজ দাগের মধ্যে (এটা সেই জায়গা, যেখানে হজরত হাজেরা (রা·) পানির জন্য দৌড়েছিলেন) একটু দ্রুত পথ চলে মারওয়ায় পেঁৗছালে এক চক্কর পূর্ণ হলো। মারওয়া পাহাড়ে উঠে কাবা শরিফের দিকে মুখ করে দোয়ার মতো করে হাত তুলে তাকবির পড়ুন এবং আগের মতো চলে সেখান থেকে সাফায় পেঁৗছালে দ্বিতীয় চক্কর পূর্ণ হলো এভাবে সপ্তম চক্করে মারওয়ায় গিয়ে সাঈ শেষ করে দোয়া করুন।
৫· হলক করা (ওয়াজিব)
পুরুষ হলে রাসুলুল্লাহ (সা·)-এর আদর্শের অনুসরণে সম্পূর্ণ মাথা মুণ্ডন করবেন, তবে মাথার চুল ছাঁটতেও পারেন। মহিলা হলে চুলের মাথা এক ইঞ্চি পরিমাণ কাটবেন।
এ পর্যন্ত উমরাহর কাজ শেষ।
হজের ইহরাম না বাঁধা পর্যন্ত ইহরামের আগের মতো সব কাজ করতে পারবেন।
৬· হজের ইহরাম (ফরজ)
হারাম শরিফ বা বাসা থেকে আগের নিয়মে শুধু হজের নিয়তে ইহরাম বেঁধে ৮ জিলহজ জোহরের আগেই মিনায় পৌঁছে যাবেন।
৭· মিনায় অবস্থান (সুন্নত)
৮ জিলহজ জোহর থেকে ৯ জিলহজ ফজরসহ মোট পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মিনায় আদায় করুন এবং এ সময়ে মিনায় অবস্থান করুন।
৮· আরাফাতের ময়দানে অবস্থান (ফরজ)
আরাফাতের ময়দানে অবস্থান হজের অন্যতম ফরজ।
৯ জিলহজ দুপুরের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করুন। এদিন নিজ তাঁবুতে জোহর ও আসরের নামাজ স্ব স্ব সময়ে আলাদাভাবে আদায় করুন। মুকিম হলে চার রাকাত পূর্ণ পড়ুন। মসজিদে নামিরায় উভয় নামাজ জামাতে পড়লে একসঙ্গে আদায় করতে পারেন। যদি ইমাম মুসাফির হন আর মসজিদে নামিরা যদি আপনার কাছ থেকে দূরে থাকে, তাহলে সেখানে অবস্থান করবেন। মাগরিবের নামাজ না পড়ে মুজদালিফার দিকে রওনা হোন।
৯· মুজদালিফায় অবস্থান (সুন্নত)
আরাফায় সূর্যাস্তের পর মুজদালিফায় গিয়ে এশার সময়ে মাগরিব ও এশা এক আজান ও এক ইকামতে একসঙ্গে আদায় করুন।
এখানেই রাত যাপন করুন (এটি সুন্নত) এবং ১০ জিলহজ ফজরের পর সূর্যোদয়ের আগে কিছু সময় মুজদালিফায় অবশ্যই অবস্থান করুন (এটি ওয়াজিব)। তবে দুর্বল (অপারগ) ও নারীদের বেলায় এটা অপরিহার্য নয়। রাতে ছোট ছোট ছোলার দানার মতো ৭০টি কঙ্কর সংগ্রহ করুন। মুজদালিফায় কঙ্কর খুব সহজেই পেয়ে যাবেন।
১০· কঙ্কর মারা (প্রথম দিন)
১০ জিলহজ ফজর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত শুধু বড় জামারাকে (বড় শয়তান) সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করুন (ওয়াজিব)। এ সময়ে সম্ভব না হলে এ রাতের শেষ পর্যন্ত কঙ্কর মারতে পারেন। দুর্বল ও নারীদের জন্য রাতেই কঙ্কর মারা উত্তম ও নিরাপদ।
কঙ্কর মারার স্থানে বাংলা ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়; তা মনোযোগ দিয়ে শুনুন এবং মেনে চলুন।
১১· কোরবানি করা (ওয়াজিব)
১০ জিলহজ কঙ্কর মারার পরই কেবল কোরবানি নিশ্চিত পন্থায় আদায় করুন।
কোরবানির পরেই কেবল রাসুলুল্লাহ (সা·)-এর আদর্শের অনুসরণে মাথা হলক করুন (ওয়াজিব)। তবে চুল ছোটও করতে পারেন।
খেয়াল রাখবেনঃ কঙ্কর মারা, কোরবানি করা ও চুল কাটার মধ্যে ধারাবাহিকতা জরুরি ও ওয়াজিব; অন্যথায় দম বা কাফফারা দিয়ে হজ শুদ্ধ করতে হবে। বর্তমানে এই সমস্যা সমাধানের সহজ উপায় হজে ইফরাদ করা। যেখানে কোরবানি নেই। হজের পরে উমরাহ করা যায়।
১২· তাওয়াফে জিয়ারত (ফরজ)
১২ জিলহজ সূর্যাস্তের আগেই তাওয়াফে জিয়ারত করে নিতে হবে। তা না হলে ১২ জিলহজের পরে তাওয়াফটি করে দম দিতে হবে। তবে নারীরা প্রাকৃতিক কারণে করতে না পারলে পবিত্র হওয়ার পরে করবেন।
১৩· কঙ্কর মারা (ওয়াজিব)
১১ ও ১২ জিলহজ কঙ্কর মারা (ওয়াজিব)। ১১-১২ জিলহজ দুপুর থেকে সময় আরম্ভ হয়। ভিড় এড়ানোর জন্য আসরের পর অথবা আপনার সুবিধাজনক সময়ে সাতটি করে কঙ্কর মারবেন-প্রথমে ছোট, মধ্যম, তারপর বড় শয়তানকে। ছোট জামারা থেকে শুরু করে বড় জামারায় শেষ করুন। সম্ভব না হলে শেষরাত পর্যন্ত মারতে পারেন। দুর্বল ও নারীদের জন্য রাতেই নিরাপদ।
১৪· মিনা ত্যাগ
১৩ জিলহজ মিনায় না থাকতে চাইলে ১২ জিলহজ সন্ধ্যার আগে অথবা সন্ধ্যার পর ভোর হওয়ার আগে মিনা ত্যাগ করুন। সূর্যাস্তের আগে মিনা ত্যাগ করতেই হবে-এটা ঠিক নয়। তবে সূর্যাস্তের আগে মিনা ত্যাগ করা উত্তম।
১৫· বিদায়ী তাওয়াফ (ওয়াজিব)
বাংলাদেশ থেকে আগত হজযাত্রীদের হজ শেষে বিদায়ী তাওয়াফ করতে হয় (ওয়াজিব)। তবে হজ শেষে যেকোনো নফল তাওয়াফই বিদায়ী তাওয়াফে পরিণত হয়ে যায়।
নারীদের মাসিকের কারণে বিদায়ী তাওয়াফ করতে না পারলে কোনো ক্ষতি নেই; দম বা কাফফারাও দিতে হয় না।
১৬· মিনায় অবস্থানরত দিনগুলোতে (১০, ১১ জিলহজ) মিনাতেই রাত যাপন করুন। আর ১২ তারিখ রাত যাপন করুন যদি ১৩ তারিখ রমি (কঙ্কর ছুড়ে মারা) শেষ করে ফিরতে চান (সুন্নত)।
কিরান হজের নিয়ম
কিরান হজের নিয়ম
১· ইহরাম বাঁধা (ফরজ)
জেদ্দা পৌঁছানোর আগে একই নিয়মে ইহরাম করার কাজ সমাপ্ত করুন। তবে তালবিয়ার আগেই হজ ও উমরাহ উভয়ের নিয়ত একসঙ্গে করুন।
২· উমরাহর তাওয়াফ (পূর্বে বর্ণিত) নিয়মে আদায় করুন (ওয়াজিব)।
৩· উমরাহর সাঈ করুন, তবে এরপর চুল ছাঁটবেন না; বরং ইহরামের সব বিধিবিধান মেনে চলুন (ওয়াজিব)।
৪· তাওয়াফে কুদুম করুন (সুন্নত)।
৫· এরপর সাঈ করুন, যদি এ সময় সাঈ করতে না পারা যায় তাওয়াফে জিয়ারতের পরে করুন (ওয়াজিব)।
৬· আট জিলহজ জোহর থেকে ৯ জিলহজ ফজর পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মিনাতে পড়ুন। এ সময়ে মিনাতে অবস্থান করুন (সুন্নত)।
৭· আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করুন (ফরজ)।
৮· নয় জিলহজ সূর্যাস্তের পর থেকে মুজদালিফায় অবস্থান এবং মাগরিব ও এশা একসঙ্গে এশার সময়ে আদায় করুন (সুন্নত)। তবে ১০ জিলহজ ফজরের পর কিছু সময় অবস্থান করুন (ওয়াজিব)।
৯· ওপরে বর্ণিত নিয়ম ও সময় অনুসারে ১০ জিলহজ কঙ্কর নিক্ষেপ করুন (ওয়াজিব)।
১০· কোরবানি করুন (ওয়াজিব)।
১১· মাথার চুল মুণ্ডন করে নিন (ওয়াজিব)। তবে চুল ছেঁটেও নিতে পারেন।
১২· তাওয়াফে জিয়ারত করুন (ফরজ) এবং সাঈ করে নিন, যদি তাওয়াফে কুদুমের পরে না করে থাকেন।
১৩· এগারো-বারো জিলহজ কঙ্কর নিক্ষেপ করুন (ওয়াজিব)। ১৩ জিলহজ কঙ্কর মারা রাসুলুল্লাহ (সা·)-এর আদর্শ।
১৪· মিনায় থাকাকালীন মিনাতেই রাত যাপন করুন (সুন্নত)।
১৫· মিকাতের বাইরে থেকে আগত হাজিরা বিদায়ী তাওয়াফ করুন (ওয়াজিব)।
ইফরাদ হজের নিয়ম ১· শুধু হজের নিয়তে (আগে বর্ণিত) ইহরাম বাঁধুন (ফরজ)।
২· মক্কা শরিফ পেঁৗছে তাওয়াফে কুদুম করুন (সুন্নত)।
৩· সাঈ করুন (ওয়াজিব)। এ সময়ে সম্ভব না হলে সাঈ তাওয়াফে জিয়ারতের পরে করুন।
৪· মিনায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও রাত যাপন করুন (সুন্নত)।
৫· আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করুন (ফরজ)।
৬· মুজদালিফায় অবস্থান করুন (সুন্নত)। তবে ১০ জিলহজ ফজরের পর কিছু সময় অবস্থান ওয়াজিব।
৭· ১০ জিলহজে জামারাতে সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করুন (ওয়াজিব)।
৮· যেহেতু এ হজে কোরবানি ওয়াজিব নয়, তাই কঙ্কর নিক্ষেপের পর মাথা হলক করে নিন; তবে চুল ছেঁটেও নিতে পারেন (ওয়াজিব)।
৯· তাওয়াফে জিয়ারত করুন (ফরজ) এবং যদি তাওয়াফে কুদুমের পর সাঈ না করে থাকেন, তাহলে সাঈ করে নিন (ওয়াজিব)।
১০· ১১-১২ জিলহজ আগে বর্ণিত নিয়ম ও সময়ে কঙ্কর নিক্ষেপ করুন (ওয়াজিব)।
১১· বদলি হজকারী ইফরাদ হজ করবেন।
ইহরাম, অন্যান্য পরামর্শ ও মক্কায় যা দ��
ইহরাম সম্পর্কে জরুরি বিষয়
যাঁরা সরাসরি বাংলাদেশ থেকে মক্কা শরিফ যাবেন, তাঁরা বাড়িতে, হাজি ক্যাম্পে বা বিমানে ইহরাম করে নেবেন। বাড়িতে বা হাজি ক্যাম্পে ইহরাম করে নেওয়া সহজ। ইহরাম ছাড়া যেন মিকাত অতিক্রম না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
যাঁরা মদিনা শরিফ যাবেন, তাঁরা মদিনা শরিফ থেকে মক্কা যাওয়ার সময় ইহরাম করবেন। কোনো নারী প্রাকৃতিক কারণে অপবিত্র হয়ে থাকলে ইহরামের প্রয়োজন হলে অজু-গোসল করে নামাজ ব্যতীত লাব্বাইক পড়ে ইহরাম করে নেবেন। তাওয়াফ ছাড়া হজ, উমরাহর সমস্ত কাজ নির্ধারিত নিয়মে আদায় করবেন।
তাওয়াফ ও সাঈ করার সময় বিশেষভাবে লক্ষণীয়
তাওয়াফের সময় অজু থাকা জরুরি। তবে সাঈ করার সময় অজু না থাকলেও সাঈ সম্পন্ন হয়ে যাবে।
হাজরে আসওয়াদে চুমু দেওয়া একটি সুন্নত। তা আদায় করতে গিয়ে লোকজনকে ধাক্কাধাক্কির মাধ্যমে কষ্ট দেওয়া বড় গুনাহ। তাই তাওয়াফকালে বেশি ভিড় দেখলে ইশারায় চুমু দেবেন।
সাঈ করার সময় সাফা থেকে মারওয়া কিংবা মারওয়া থেকে সাফা প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন চক্কর। এভাবে সাতটি চক্কর সম্পূর্ণ হলে একটি সাঈ পূর্ণ হবে।
অন্যান্য পরামর্শ
সৌদি আরবে অবস্থানকালে কোনো চাঁদা ওঠানো, সাহায্য চাওয়া, ভিক্ষা করা দণ্ডনীয় অপরাধ। সুতরাং এগুলো থেকে বিরত থাকুন।
সৌদি আরবে অবস্থানকালে ট্রাফিক আইন মেনে চলুন, সিগন্যাল পড়লে রাস্তা পার হোন। রাস্তা পার হওয়ার সময় অবশ্যই ডানে-বাঁয়ে দেখেশুনে সাবধানে পার হবেন। কখনো দৌড় দেবেন না।
কাবা শরিফ ও মসজিদে নববীর ভেতরে কিছুদূর পরপর পবিত্র কোরআন মজিদ রাখা আছে আর পাশে জমজম পানি (স্বাভাবিক ও ঠান্ডা) খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
মনে রাখবেন, মসজিদে নববী ও হারামের সীমানার মধ্যে ধূমপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
শরীরের কোনো স্থান কেটে গেলে অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম ব্যবহার করুন এবং ক্ষতস্থানটি প্লাস্টার কিংবা ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢেকে দিন।
হাঁচি কিংবা কাশি দেওয়ার সময় অবশ্যই আপনার মুখ ঢেকে নিন।
হজযাত্রীদের যাবতীয় তথ্য, দেশের পরিবার-পরিজনের কাছে ই-মেইলের মাধ্যমে সংবাদ পৌঁছানো যায়। হারানো হজযাত্রীদের খুঁজে পাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে বাংলাদেশ হজ মিশনে অবস্থিত হাতিল আইটি ইনফরমেশন সার্ভিসেস সাহায্য করে।
কোনো ধরনের অসুস্থতা কিংবা দুর্ঘটনায় পড়লে বাংলাদেশ হজ মিশনের মেডিকেল সদস্যদের (চিকিৎসক) সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
হজের সময় হজযাত্রীদের যেন কোনো রকম কষ্ট না হয়। আপনার ট্রাভেল এজেন্সি আপনাকে যথাযথ সুবিধাদি (দেশ থেকে আপনাকে থাকা, খাওয়াসহ অন্য যেসব সুবিধার কথা বলেছিল) না দিলে আপনি মক্কা ও মদিনার বাংলাদেশ হজ মিশনকে জানাতে পারেন। এতেও আপনি সন্তুষ্ট না থাকলে সৌদির ওজারাতুল হজকে (হজ মন্ত্রণালয়) লিখিত অভিযোগ করতে পারেন।
মক্কায় যা দেখবেন
মসজিদুল হারাম (কাবা শরিফ)।
সাফা ও মারওয়া।
মসজিদুল হারামের পূর্ব দিকে সাফা-মারওয়া পাহাড় পার হয়ে বাইরে গেলে পথের পাশে দোতলা একটি দালানে মক্কা লাইব্রেরি।
কয়েকটি বিশিষ্ট স্থানের পরিচয়
মাতাফঃ কাবাঘরের চারদিকে অবস্থিত তওয়াফের স্থানকে মাতাফ বা চত্বর বলা হয়।
হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথরঃ কাবা শরিফের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে লাগানো আছে একটি কালো পাথর, এটিই হাজরে আসওয়াদ। মুসলমানদের কাছে এই পাথর অতি মূল্যবান ও পবিত্র। তাদের কাছে এটি বেহেশতি পাথর, তাই এতে চুমু দেওয়ার ফজিলতও বেশি। হাজরে আসওয়াদ তাওয়াফ (কাবা শরিফ সাতবার চক্কর দেওয়া) শুরুর স্থান। প্রতিবার চক্কর দেওয়ার সময় এই হাজরে আসওয়াদে চুমু দিতে হয়। ভিড়ের কারণে না পারলে চুমুর ইশারা করলেও চলে-এটাই নিয়ম।
কাবাঘরঃ কাবাঘর প্রায় বর্গাকৃতির। এর র্দৈঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে আনুমানিক ৪৫ ও ৪০ ফুট। কাবা শরিফের দরজা একটি এবং দরজাটি কাবাঘরের পূর্ব দিকে অবস্থিত।
মিযাবে রহমতঃ বায়তুল্লাহর উত্তর দিকের ছাদে (হাতিমের মাঝ বরাবর) যে নালা বসানো আছে, তাকে মিযাবে রহমত বলা হয়। এই নালা দিয়ে ছাদের বৃষ্টির পানি পড়ে।
মাকামে ইবরাহীমঃ কাবা শরিফের পাশেই আছে ক্রিস্টালের একটি বাক্স, চারদিকে লোহার বেষ্টনী। ভেতরে বর্গাকৃতির একটি পাথর। পাথরটির দৈর্ঘø, প্রস্থ ও উচ্চতা সমান, প্রায় এক হাত। এ পাথরটিই মাকামে ইবরাহীম। মাকাম শব্দের একটি অর্থ হচ্ছে দাঁড়ানোর স্থান। অর্থাৎ হজরত ইবরাহীম (আ·) এর দাঁড়ানোর স্থান।
হাতিমঃ কাবাঘরের উত্তর দিকে অর্ধবৃত্তাকার মানুষ-সমান উঁচু প্রাচীরে ঘেরা একটি স্থান।
জান্নাতুল মুআল্লাঃ মসজিদুল হারামের পূর্ব দিকে মক্কা শরিফের বিখ্যাত কবরস্থান।
গারে হেরাঃ মক্কার সর্বাধিক উচ্চ পাহাড়ের একটি নির্জন স্থান। এখানে নবী করিম (সা·) ধ্যানমগ্ন থাকতেন এবং এখানেই সর্বপ্রথম ওহি নাজিল হয়।
গারে সাওরঃ মসজিদুল হারামের পশ্চিমে হিজরতের সময় এই প্রকাণ্ড সুউচ্চ পাহাড়ে রাসুলুল্লাহ (সা·) তিন দিন অবস্থান করেছিলেন।
জাবাল-ই-রহমতঃ আরাফাতের ময়দানে অবস্থিত। এ পাহাড়ে সর্বপ্রথম নবী হজরত আদম (আ·) এর দোয়া কবুল হয়। এখানে তিনি বিবি হাওয়া (আ·) এর সাক্ষাৎ পান। ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা·) বিদায় হজের খুতবাও এখান থেকেই দিয়েছিলেন।
জমজম কূপঃ দুনিয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের যত অনুপম নিদর্শন আছে, তার মধ্যে মক্কা শরিফে অবস্থিত জমজম কূপ অন্যতম। জমজম কূপের ইতিহাস কমবেশি সবারই জানা। এ কূপের পানি সর্বাধিক স্বচ্ছ, উৎকৃষ্ট, পবিত্র ও বরকতময়। এ পানি শুধু পিপাসাই মেটায় না; এতে ক্ষুধাও নিবৃত্ত হয়। এ সম্পর্কে রাসুলে করিম (সা·) বাণী প্রদান করেছেন, এ পানি শুধু পানীয় নয়; বরং খাদ্যের অংশ এবং এতে পুষ্টি রয়েছে।
হজ পালন করতে গিয়ে মক্কায় কিসওয়া তৈরির কারখানা দেখে আসতে পারেন। ট্যাক্সিতে কাবা শরিফ থেকে ১০ রিয়ালে পেঁৗছে যাবেন কিসওয়া। পাশেই মক্কা-মদিনার দুই হারাম শরিফে ব্যবহূত জাদুঘর। জাদুঘরে দেখতে পাবেন বিভিন্ন রকম কিসওয়া (কাবার গিলাফ)। সেখানে অনেক বাংলাদেশি চাকরি করেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে আরও অনেক কিছু জানতে পারবেন।
আরও কিছু করণীয়
আরও কিছু করণীয়
আরাফাতের ময়দানে অনেক প্রতিষ্ঠান বিনা মূল্যে খাবার, জুস, ফল ইত্যাদি দিয়ে থাকে। ওই সব খাবার আনতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি হয়, তাই সাবধান থাকবেন।
মুজদালিফায় রাতে থাকার জন্য প্লাস্টিকের পাটি পাওয়া যায়। মক্কায়ও কিনতে পারবেন।
আরাফাতের ময়দান থেকে যদি হেঁটে মুজদালিফায় আসেন, পথে টয়লেট সেরে নেবেন। কেননা মুজদালিফার টয়লেটে অনেক ভিড় লেগে যায়।
হজ মন্ত্রণালয় মিনার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে (যেখানে হজযাত্রীদের সহজে চোখে পড়ে) কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত ইলেকট্রনিক বিলবোর্ডে পৃথিবীর প্রায় ১৮টি ভাষায় বিভিন্ন জরুরি দিকনির্দেশনা ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বাংলায় প্রচার করে।
হজের বেশির ভাগ সময় হজযাত্রীদের মিনায় তাঁবুতে অবস্থান করতে হয়। তাই মিনাকে এক হিসেবে তাঁবুর শহর বলা যায়। চারদিকে তাঁবু আর তাঁবু-সব তাঁবু দেখতে একই রকম। মোয়াল্লেম নম্বর বা তাঁবু নম্বর জানা না থাকলে যে কেউই হারিয়ে যেতে পারেন। বিশেষ করে বাংলাদেশি হজযাত্রীদের বড় অংশ বৃদ্ধ বয়সে হজ করতে আসেন। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঙ্গে রাখেন না। অনেকে হারিয়ে ফেলেন গন্তব্য। বাংলাদেশি হজযাত্রী কিছু আছেন সচেতন, তাঁরা বাদে বাকিরা তাঁবু নম্বর মনে রাখতে পারেন না। সব তাঁবু দেখতে একই রকম হওয়ায় পথ হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশের পতাকা বা বাংলায় কথা বলা শুনে প্রবাসী বাংলাদেশি হজকর্মীরা তাঁদের গন্তব্যে পৌঁছে দেন।
এ সমস্যা এড়ানোর জন্য যে তাঁবুতে অবস্থান করেন, সেসব তাঁবু চিহ্নিত করে নিন।
মোয়াল্লেম অফিস থেকে তাঁবুর নম্বরসহ কার্ড দেওয়া হয়; তা যত্নে রাখুন। বাইরে বের হওয়ার সময় সঙ্গে রাখুন।
হজযাত্রী সচেতন থাকলে হারিয়ে যাওয়ার কোনো ভয় নেই। অনেক বাংলাদেশি হারিয়ে যাওয়ার কারণে হজের আহকাম বা নিয়ম-কানুন ঠিকমতো পালন করতে পারেন না।
মক্কা-মদিনায় প্রচুর বাংলাদেশি হোটেল আছে। মক্কার হোটেলগুলোর নাম ঢাকা, এশিয়া, চট্টগ্রাম, জমজম ইত্যাদি। এসব হোটেলে ভাত, মাছ, মাংস, সবজি, ডাল-সবই পাওয়া যায়। হোটেল থেকে পার্সেলে বাড়িতে খাবার নিয়ে দুজন অনায়াসে খেতে পারেন।
মক্কা-মদিনায় প্রচুর ফলমূল ও ফলের রস পাওয়া যায়। এগুলো কিনে খেতে পারেন।
মক্কা-মদিনায় অনেক বাংলাদেশি কাজ করেন, তাই ভাষাগত কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কেনাকাটার সময় দরদাম করে কিনবেন।
হজের সময় প্রচুর হাঁটাচলা করতে হয়, পকেটে টাকা থাকলেও যানবাহন পাওয়া যায় না।
মিনায় চুল কাটার লোক পাওয়া যায়। নিজেরা নিজেদের চুল কাটবেন না, এতে মাথা কেটে যেতে পারে।
মিনায় কোনো সমস্যা হলে হজযাত্রীদের সেবা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ হজ মিশনের তাঁবুতে যোগাযোগ করবেন।
মক্কা-মদিনা থেকে বাংলাদেশে কম খরচে ফোন করা যায় (কোনো বাংলাদেশিকে বললে দেখিয়ে দেবেন)। সৌদি আরবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে চাইলে সঙ্গে সেট নিয়ে যাবেন, ওখানে (হজ প্যাকেজ) মোবাইল সিম কিনতে পাওয়া যায়।
হজের আগে ও পরে আরও উমরাহ করতে চাইলে তানঈম মসজিদ-এ (উমরাহ মসজিদে) গিয়ে উমরাহর নিয়ত করে আসা যায়। কাবা শরিফের বাইরে বাস অথবা ট্যাক্সিতে দুই রিয়ালে উমরাহ মসজিদে যাওয়া যায়।
মক্কায় কাবা শরিফ ছাড়াও জাবাল-ই-রহমত (আরাফাতের ময়দানে অবস্থিত), জাবাল-ই-নূর (যেখানে রাসুলুল্লাহ (সা·) ধ্যান করতেন; এখানে পবিত্র কোরআনের আয়াত নাজিল হয়), মিনায় আল-খায়েফ মসজিদ, নামিরা মসজিদ, আরাফাতের ময়দান, মুজদালিফা, জাবাল-ই-সাওর প্রভৃতি ঐতিহাসিক স্থানে ঘুরে আসা যায়।
জিয়ারতে মদিনা মুনাওয়ারা
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা·) এর জিয়ারতে মোবারক সর্বসম্মতভাবে শ্রেষ্ঠ সওয়াবের কাজ। মর্যাদা ও উন্নতি লাভের জন্য এর চেয়ে শ্রেয়তর ও বড় মাধ্যম আর নেই। কোনো কোনো আলেম একে ওয়াজিব বলে গণ্য করেছেন। বড়ই সৌভাগ্যবান সেই ব্যক্তি, যে এই মোবারকময় জিয়ারতে মদিনার তাওফিক লাভ করেন।
নবী করিম (সা·) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি হজ সম্পন্ন করল এবং আমার ইন্তেকালের পর কবর জিয়ারত করল; সে যেন জীবদ্দশায়ই আমার জিয়ারত করল। (মিশকাত)
রাসুলুল্লাহ (সা·) আরও ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আমার কবর জিয়ারত করল, আমার ওপর তার জন্য শাফায়াত (সুপারিশ) ওয়াজিব হয়ে গেল। (ফাতহুল কাদীর)
এ জন্য সংগতিপূর্ণ প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানের এই সৌভাগ্য অর্জন করা উচিত।
মসজিদে নববীতে এক ওয়াক্ত নামাজের সওয়াব সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিম শরিফের বর্ণনা অনুযায়ী অন্য জায়গার এক হাজার ওয়াক্তের চেয়েও বেশি।
ইবনে মাজাহ্র এক রেওয়ায়াতে একে ৫০ হাজার ওয়াক্ত নামাজের সমান বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র·) হজরত আনাস (রা·) থেকে বর্ণনা করেছেনঃ নবী করিম (সা·) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আমার মসজিদে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে এবং একটি নামাজও বাদ দেবে না, তার জন্য দোজখ থেকে মুক্তির ছাড়পত্র লিখে দেওয়া হবে। এ জন্য মসজিদে নববীতে জামাতে নামাজ পড়ার বিশেষ চেষ্টা রাখতে হবে। মসজিদে নববীতে ইবাদত করুন। কোরআন শরিফও তিলাওয়াত করতে পারেন।
মদিনার মিসকিন, প্রতিবেশী এবং স্থায়ী বাসিন্দাদের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখুন। সাধ্য অনুযায়ী দান-খয়রাত করুন। সেখানে থেকে কেনাকাটার সময়ও তাদের সাহায্যের নিয়ত করুন; এতে অনেক সওয়াব পাবেন।
মদিনা থেকে যদি মক্কায় আসেন, তাহলে ইহরামের কাপড় সঙ্গে নিতে হবে।
রাসুলে করিম (সা·)-এর রওজা জিয়ারত
রাসুলে করিম (সা·)-এর রওজা জিয়ারত জিয়ারত ও নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে মদিনায় যাওয়া সুন্নত। মসজিদে নববীতে নামাজ পড়ায় ফজিলত বেশি।
মসজিদে নববীতে জিয়ারতের জন্য ইহরাম বাঁধতে বা তালবিয়া পড়তে হয় না। তবে মদিনা থেকে যদি মক্কায় আবার আসতে হয়, তাহলে মিকাত বীর আলী পার হলে ইহরাম বেঁধে আসতে হবে।
রওজায়ে জান্নাত বা রিয়াজুল জান্নাহ
হুজরায়ে মোবারক ও মিম্বার শরিফের মাঝখানের জায়গাটি রওজায়ে জান্নাত বা রিয়াজুল জান্নাহ বা বেহেশতের বাগান নামে পরিচিত। এ স্থানটির বিশেষ ফজিলত রয়েছে। এখানে নামাজ পড়ারও বিশেষ ফজিলত আছে।
মসজিদে নববীতে কয়েকটি ঐতিহাসিক স্তম্ভ
উস্তুওয়ানা হান্নানা (সুবাস স্তম্ভ) মিম্বারে নববীর ডান পাশে খেজুরগাছের গুঁড়ির স্থানে নির্মিত স্তম্ভটি। নবী করিম (সা·) মিম্বার স্থানান্তরের সময় এ গুঁড়িটি উঁচু স্বরে কেঁদেছিলেন।
উস্তুওয়ানা সারীরঃ এখানে রাসুলুল্লাহ (সা·) ইতিকাফ করতেন এবং রাতে আরামের জন্য তাঁর বিছানা এখানে স্থাপন করা হতো। এ স্তম্ভটি হুজরা শরিফের পশ্চিম পাশে জালি মোবারকের সঙ্গে রয়েছে।
উস্তুওয়ানা উফুদঃ বাইরে থেকে আগত প্রতিনিধিদল এখানে বসে রাসুলুল্লাহ (সা·)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করতেন এবং এখানে বসেই কথা বলতেন। এ স্তম্ভটিও জালি মোবারকের সঙ্গে রয়েছে।
উস্তুওয়ানা আয়েশা (আয়েশা স্তম্ভ)- নবী করিম (সা·) বলেছেন, আমার মসজিদে এমন একটি জায়গা রয়েছে, লোকজন যদি সেখানে নামাজ পড়ার ফজিলত জানত, তাহলে সেখানে স্থান পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করত। স্থানটি চিহ্নিত করার জন্য সাহাবায়ে কিরাম চেষ্টা করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা·)-এর ইন্তেকালের পর হজরত আয়েশা (রা·) তাঁর ভাগ্নে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইরকে (রা·) সে জায়গাটি চিনিয়ে দেন। এটিই সেই স্তম্ভ। এই স্তম্ভটি উস্তুওয়ানা উফুদের পশ্চিম পাশে রওজায়ে জান্নাতের ভেতর।
উস্তুওয়ানা আবু লুবাবা (তওবা স্তম্ভ)- হজরত আবু লুবাবা (রা·) থেকে একটি ভুল সংঘটিত হওয়ার পর তিনি নিজেকে এই স্তম্ভের সঙ্গে বেঁধে বলেছিলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত হুজুরে পাক (সা·) নিজে না খুলে দেবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি এর সঙ্গে বাঁধা থাকব। নবী করিম (সা·) বলেছিলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আমাকে আল্লাহ আদেশ না করবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত খুলব না। এভাবে দীর্ঘ ৫০ দিন পর হজরত আবু লুবাবা (রা·)-এর তওবা কবুল হলো। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা·) নিজ হাতে তাঁর বাঁধন খুলে দিলেন। এটি উস্তুওয়ানা উফুদের পশ্চিম পাশে রওজায়ে জান্নাতের ভেতর অবস্থিত।
উস্তুওয়ানা জিবরাইলঃ ফেরেশতা হজরত জিবরাইল (আ·) যখনই হজরত দেহইয়া কালবী (রা·)-এর আকৃতি ধারণ করে ওহি নিয়ে আসতেন, তখন অধিকাংশ সময় তাঁকে এখানেই উপবিষ্ট দেখা যেত।
মিহরাবে নববীঃ মাকরুহ ওয়াক্ত না হলে কাউকে কষ্ট না দিয়ে এখানে নফল নামাজ পড়ুন। মিহরাবের ডানে রাসুলুল্লাহ (সা·)-এর দাঁড়ানোর জায়গা।
নবী করিম (সা·)-এর রওজা মোবারক
সালাম পেশ করার নিয়ম
কিবলার দিকে পিঠ করে নবী করিম (সা·)-এর চেহারা মোবারককে সামনে রেখে এমনভাবে দাঁড়াতে হবে, যেন রাসুলুল্লাহ (সা·) আপনার সামনে। এ সময় পৃথিবীর যাবতীয় চিন্তাভাবনা থেকে দিলকে মুক্ত করে একমন, একদিল হয়ে অত্যন্ত আদবের সঙ্গে সালাম পেশ করতে হবে। এ রকম খেয়াল করতে হবে যে, নবী করিম (সা·) কবর মোবারকে কিবলার দিকে মুখ করে আরাম করছেন এবং সালাম-কালাম শ্রবণ করছেন।
মদিনার প্রাণকেন্দ্র মসজিদে নববী
ইসলামে ফজিলত লাভের উদ্দেশ্যে কেবল তিন মসজিদে ভ্রমণ করার অনুমোদন আছে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো মক্কা মুকাররমা বা কাবা শরিফ (সৌদি আরব)। দ্বিতীয়টি হচ্ছে মসজিদ আল-আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাসঃ ইসলামের প্রথম কিবলা মসজিদ (ফিলিস্তিন)। তৃতীয়টি হলো মদিনা আল-মুনাওয়ারার মসজিদে নববীঃ নবীজিকে যেখানে চির শয়নে শায়িত করা হয়েছে। মদিনা নবীর শহর, একে আরবিতে বলা হয় মদিনাতুন নবী। আর মদিনার প্রাণকেন্দ্র হলো মসজিদে নববী। মদিনার ৯৫টি নাম রয়েছে, যেমন দারুস সালাম (শান্তির ঘর)। তা ছাড়া মদিনার ৯৯টি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা·) মদিনার বরকতের জন্য দোয়া করেছেন, একে হারাম বা সম্মানিত ঘোষণা করেছেন। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছেঃ ঘর থেকে অজু করে মসজিদে কুবায় গিয়ে নামাজ পড়লে একটি উমরাহর সওয়াব পাওয়া যায়।
মসজিদে নববীর ভেতরে স্বয়ংক্রিয় ছাদের ব্যবস্থা আছে, যা দিনের বেলা সুইচের মাধ্যমে খুলে দেওয়া হয় আর রাতে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পাশেই জান্নাতে বাকি গোরস্তান। এখানে ফাতেমা (রা·), মা হালিমা ও হজরত ওসমান (রা·)সহ অগণিত সাহাবা (রা·)-এর কবর রয়েছে। এর একপাশে নতুন কবর হচ্ছে প্রত্যহ। এখানে শুধু একটি পাথরের খণ্ড দিয়ে চিহ্নিত করা আছে একেকটি কবর। কেউ কেউ একে বাকি গোরস্তান বলে সম্বোধন করেন।
মসজিদে নববীর উত্তর দিকের গেট দিয়ে বেরিয়েই সাহাবাদের মসজিদ। পাশাপাশি দুটি এবং একটি একটু দূরে একই ডিজাইনে করা তিনটি মসজিদ। এগুলোকে সাহাবা মসজিদ বলা হয়।
মসজিদে নববীতে নারীদের জন্য আলাদা নামাজ পড়ার জায়গা আছে।
ভেতরে কিছুদূর পরপর পবিত্র কোরআন মজিদ রাখা আছে, আর পাশে আছে জমজম পানি খাওয়ার ব্যবস্থা।
রাসুলুল্লাহ (সা·)-এর রওজা মোবারক
উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা·) এর কক্ষেই রাসুলুল্লাহ (সা·)-এর ওফাত হয় এবং সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। মসজিদ সম্প্রসারণ করার পর বর্তমানে তাঁর কবর মসজিদে নববীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। রাসুলে করিম (সা·)-এর রওজার ডানদিকে খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা·) ও খলিফা হজরত ওমর ফারুক (রা·)-এর কবর। মসজিদে নববীতে সালাত আদায় ও দোয়া করার উদ্দেশ্যেই মদিনায় গমন এবং সালাত আদায় করে রাসুলুল্লাহ (সা·)-এর রওজা শরিফ জিয়ারত করা ও সালাম পৌঁছানোর ইচ্ছা প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানের থাকে।
মদিনার কয়েকটি ঐতিহাসিক মসজিদ
মদিনায় অনেক ঐতিহাসিক মসজিদ রয়েছে।
মসজিদে মিকাতঃ মদিনা থেকে মক্কা যাওয়ার পথে মসজিদে নববী থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে এ মসজিদটি অবস্থিত। ঐতিহাসিক আকীক উপত্যকার পশ্চিম পাশে মসজিদটি রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা·) হজ বা উমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা যাওয়ার সময় এখানকার একটি গাছের নিচে অবতরণ করতেন এবং সেখানে সালাত আদায় করে উমরাহ অথবা হজের ইহরাম বাঁধতেন। এ কারণেই মসজিদটিকে শাজারাহ্ বলা হয়। মদিনাবাসীর মিকাত বলে এ মসজিদটি মসজিদে মিকাত নামে পরিচিত।
মসজিদে জুমুআঃ রাসুলুল্লাহ (সা·) হিজরতের সময় কুবার অদূরে রানুনা উপত্যকায় একশ সাহাবাকে নিয়ে মসজিদে জুমুআর স্থানে প্রথম জুমুআর সালাত আদায় করেন।
মসজিদে গামামাহঃ এ মসজিদকে মোসাল্লাহও বলা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা·) প্রথম ঈদের সালাত ও শেষ জীবনের ঈদের সালাতগুলো মসজিদে গামামাহর স্থানে আদায় করেন। এ স্থানে রাসুলুল্লাহ (সা·) বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়েছেন বলে একে মসজিদে গামামাহ বলা হয়। এটি মসজিদে নববীর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত।
মসজিদে আবু বকর (রা·)- এটি মসজিদে গামামাহর উত্তরে অবস্থিত। হজরত আবু বকর (রা·) খলিফা থাকাকালে এ মসজিদে ঈদের সালাত পড়ান। তাই এটি মসজিদে আবু বকর (রা·) হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
কিবলাতাঈন মসজিদঃ এ মসজিদে একই নামাজ দুই কিবলামুখী হয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। নামাজ পড়তে দাঁড়িয়ে ওহি পাওয়ার পর আল-আকসা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নামাজের মাঝখানে মক্কামুখী হয়ে পরবর্তী অংশ সম্পন্ন করা হয়। এ জন্য এ মসজিদের নাম কিবলাতাঈন (দুই কিবলা মসজিদ) রাখা হয়। মসজিদের ভেতরে মূল পুরোনো মসজিদের অংশ অক্ষত রেখে চারদিকে দালান করে মসজিদ বাড়ানো হয়েছে।
মসজিদে কুবাঃ হজরত মুহাম্মদ (সা·) মদিনায় আগমন করে প্রথম শহরের প্রবেশদ্বারে কুবায় নামাজ পড়েন। পরে এখানে মসজিদ গড়ে ওঠে। কুবায় এসে আপনি দুই রাকাত নামাজ পড়তে পারেন। মদিনায় আরও বেশি সময় পেলে দেখে আসতে পারেন খাইবার।
সময় পেলে দেখতে পারেন মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়, কোরআন ছাপা প্রকল্প। এখানে প্রতি মিনিটে ৫০০ কোরআন ছাপা হয়।
ওহুদঃ ইসলামের দ্বিতীয় যুদ্ধ এটি। দুই মাথাওয়ালা একটি পাহাড়, দুই মাথার মাঝখানে একটু নিচুমতো-এটাই ওহুদের পাহাড়। তৃতীয় হিজরির শাওয়াল মাসে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
মসজিদে কুবা, কিবলাতাঈন, ওহুদ পাহাড়, খন্দকের পাহাড় প্রভৃতি দেখার জন্য মসজিদে নববীর বাইরে প্রবেশপথের কাছে ট্যাক্সিচালকেরা প্যাকেজের ব্যবস্থা করেন। খরচ মাত্র ১০ রিয়াল।
ইহরাম অবস্থায় যেসব কাজ নিষিদ্ধ
ইহরাম অবস্থায় যেসব কাজ নিষিদ্ধ * সহবাস এবং ওই বিষয়ে কোনো আলোচনা করা যাবে না।
* পুরুষদের জন্য শরীরের আকৃতি নেয় এমন কোনো সেলাই করা জামা, পায়জামা ইত্যাদি পরা বৈধ নয়।
* কথা ও কাজে কাউকে কষ্ট দেওয়া যাবে না।
* পুরুষদের ক্ষেত্রে মাথা বা মুখ ঢাকা যাবে না; এমনকি টুপিও পরা যাবে না।
* মহিলাদের মাথায় অবশ্যই কাপড় রাখতে হবে, তবে মুখমণ্ডল স্পর্শ করে এমন কাপড় পরবেন না।
* নখ, চুল, দাড়ি-গোঁফ ও শরীরের একটি পশমও কাটা বা ছেঁড়া যাবে না।
* কোনো ধরনের সুগন্ধি লাগানো যাবে না।
* কোনো ধরনের শিকার করা যাবে না।
* ক্ষতিকারক সকল প্রাণী মারা যাবে। ক্ষতি করে না এমন কোনো প্রাণী মারা যাবে না।
দোয়া কবুলের জায়গা
পবিত্র মক্কায় কাবা শরিফের বিভিন্ন জায়গায় দোয়া কবুল হয়ে থাকে। সেসব জায়গায় খুব আদব, ভক্তি ও বিনয়ের সঙ্গে খাস দিলে দোয়া করা দরকার। দুনিয়ার যাবতীয় জায়েজ নেক মাকসুদের জন্য দোয়া করা উচিত।
* মাতাফ-তাওয়াফ করার স্থানকে মাতাফ বলে।
* মুলতাযাম-হাজরে আসওয়াদ থেকে বায়তুল্লাহর দরজা পর্যন্ত স্থানে।
* হাতিমের মধ্যে।
* মিযাবে রহমতের মধ্যে।
* কাবাঘরের ভেতরে।
* জমজম কূপের কাছে (যদিও কূপ এখন বেজমেন্টের নিচে, চাইলেও এখন দেখা যায় না)।
* মাকামে ইবরাহীমের কাছে।
* সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের ওপর।
* সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝখানে।
* বায়তুল্লাহর দিকে যখন নজর পড়ে।
* রুকনে ইয়ামানি ও হাজরে আসওয়াদের মাঝখানে।
* আরাফাতের ময়দানে।
* মুজদালিফার ময়দানে।
* মিনার ময়দানে এবং মিনার মসজিদে খায়েফে।
* কঙ্কর মারার স্থানে।
সালাম পাঠ করুন
রাসুলুল্লাহ (সা·)-এর সম্মান ও মর্যাদার কথা স্মরণ করে মধ্যম আওয়াজে সালাম পেশ করতে হবে। সালাম এভাবে পাঠ করুন-
আসসালাতু আসসালামু আলাইকা আইয়ুহান্নবী ওয়া রাহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহু
আসসালাতু ওয়াস্ সালামু আলাইকা ইয়া রাসুলুল্লাহ
আসসালাতু ওয়াস্ সালামু আলাইকা ইয়া নাবীআল্লাহ
আসসালাতু ওয়াস্ সালামু আলাইকা ইয়া হাবীবাল্লাহ
আসসালাতু ওয়াস্ সালামু আলাইকা ইয়া খায়রা খালকিল্লাহ
আসসালাতু ওয়াস্ সালামু আলাইকা ইয়া সায়্যিদাল মুরসালীন
আসসালাতু ওয়াস্ সালামু আলাইকা ইয়া খাতামান নাবীয়্যীন
আসসালাতু ওয়াস্ সালামু আলাইকা ইয়া রাহমাতাল্লিল আলামীন
আসসালাতু ওয়াস্ সালামু আলাইকা ইয়া শাফীয়াল মুযনিবীন।
তারপর ডানদিকে সরে গিয়ে হজরত আবু বকর (রা·)-এর চেহারা মোবারক বরাবর দাঁড়িয়ে পাঠ করুন-
আসসালামু আলাইকা ইয়া খালিফাতি রাসুলুল্লাহি আবু বকর (রা·)।
তারপর ডানদিকে সরে গিয়ে হজরত ওমর (রা·)-এর চেহারা মোবারক বরাবর দাঁড়িয়ে পাঠ করুন-
আসসালামু আলাইকা ইয়া আমীরাল মুমিনীন ওমর ফারুক (রা·)।
একনজরে হজ
তামাত্তু কিরান ইফরাদ
১· উমরার ইহরাম (ফরজ) হজ ও উমরার ইহরাম (ফরজ) হজের ইহরাম (ফরজ)
২· উমরার তাওয়াফ (ফরজ) উমরার তাওয়াফ (ফরজ) -
৩· উমরার সাঈ (ওয়াজিব) উমরার সাঈ (ওয়াজিব) -
৪· – তাওয়াফে কুদুম (সুন্নাত) তাওয়াফে কুদুম (সুন্নাত)
৫· – সাঈ (ওয়াজিব) -
৬· মাথা মুণ্ডন করা বা চুল – -
খাটো করা (ওয়াজিব)
৮ জিলহজ জোহরের নামাজের পূর্ব থেকে
৭· হজের ইহরাম (ফরজ) – -
৮· মিনায় রাতযাপন (সুন্নত) মিনায় রাতযাপন (সুন্নাত) মিনায় রাতযাপন (সুন্নাত)
৯· জোহর, আসর, মাগরিব, জোহর, আসর, মাগরিব, এশা, জোহর, আসর, মাগরিব, এশা,
এশা, ফজর নামাজ মিনায় ফজর নামাজ মিনায় পড়া ফজর নামাজ মিনায় পড়া
পড়া (মুস্তাহাব) (মুস্তাহাব) (মুস্তাহাব)
৯ জিলহজ সূর্যোদয়ের পর
১০· আরাফাতে অবস্থান (ফরজ) আরাফাতে অবস্থান (ফরজ) আরাফাতে অবস্থান (ফরজ)
আরাফার দিন সূর্যোস্তের পর মুজদালিফার দিকে রওনা
১১· মুজদালিফায় অবস্থান মুজদালিফায় অবস্থান মুজদালিফায় অবস্থান
(ওয়াজিব) (ওয়াজিব) (ওয়াজিব)
১০ জিলহজ
১২· বড় জামরাকে (শয়তান) বড় জামরাকে (শয়তান) বড় জামরাকে (শয়তান)
কঙ্কর মারা (ওয়াজিব) কঙ্কর মারা (ওয়াজিব) কঙ্কর মারা (ওয়াজিব)
১৩· কুরবানি করা (ওয়াজিব) কুরবানি করা (ওয়াজিব) -
১৪· মাথার চুল পুরো ফেলে দেওয়া মাথার চুল পুরো ফেলে দেওয়া মাথার চুল পুরো ফেলে দেওয়া
বা চুল খাটো করা (ওয়াজিব) বা চুল খাটো করা (ওয়াজিব) বা চুল খাটো করা (ওয়াজিব)
শারীরিক সম্পর্ক ছাড়া সবকিছু হালাল হবে
১৫· তাওয়াফ (ইফাজা বা তাওয়াফ (ইফাজা বা জিয়ারত) তাওয়াফ (ইফাজা বা
জিয়ারত) (ফরজ) (ফরজ) জিয়ারত) (ফরজ)
সম্পূর্ণ হালাল হয়ে যাবে
১৬· সাঈ (ওয়াজিব) – সাঈ (ওয়াজিব)
১১-১২ জিলহজ জোহরের সময় থেকে শুরু করে কঙ্কর মারা
১৭· ১১-১২ তারিখ ছোট, মধ্যম, ১১-১২ তারিখ ছোট, মধ্যম, ১১-১২ তারিখ ছোট, মধ্যম,
বড় শয়তানকে পাথর মারা বড় শয়তানকে পাথর বড় শয়তানকে পাথর
(ওয়াজিব) মারা (ওয়াজিব) মারা (ওয়াজিব)
১৮· বিদায়ী তাওয়াফ (ওয়াজিব) বিদায়ী তাওয়াফ (ওয়াজিব) বিদায়ী তাওয়াফ (ওয়াজিব)
উল্লেখ্য, ইফরাদ ও কেরান হজকারী তাওয়াফে কুদুম করবেন। তাওয়াফে কুদুমের সঙ্গে সাঈ করলে তাওয়াফে জিয়ারতের পর আর সাঈ করতে হবে না।তবে কেরান হজকারীদের জন্যতাওয়াফে কুদুমের সঙ্গে সাঈ করা, ইফরাদ হজকারীদের জন্য তাওয়াফে জিয়ারতের সঙ্গে সাঈ করা উত্তম। তামাত্তুকারীরা হজের ইহরামের পরে নফল তাওয়াফ করে সাঈ করে নিলে তাওয়াফে জিয়ারত বা ইফাজের সময় আর সাঈ করতে হবে না।
প্রিন্ট Share Email Facebook
সম্পাদনা
মুফতি মুহাম্মদ মুহিববুল্লাহিল বাকী নদভী
পেশ ইমাম, জাতীয়মসজিদ বায়তুল মোকাররম, ঢাকা।
সহযোগিতায়
ড· মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
সহকারী অধ্যাপক, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়
সংকলনে
আলহাজ ফেরদৌস ফয়সাল
কৃতজ্ঞতায়ঃ ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা, ঢাকা, বাংলাদেশ।
, বিমানের টিকিট সংগ্রহ ও তারিখ নিশ্চিত (কনফার্ম) করা, প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করা, ম্যানিনজাইটিস টিকা বা অন্যান্য ভ্যাকসিন দেওয়া (অনেকে দালালের মাধ্যমে ১০০ বা ২০০ টাকায় টিকা দেওয়ার সনদ সংগ্রহ করেন, এটা করবেন না)-হজের এসব নিয়ম জানার জন্য একাধিক বই পড়তে পারেন। অথবা যাঁরা পড়তে পারেন না, তাঁরা হজে যাঁরা গেছেন, তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করুন। হজের কোনো বিষয়ে বিভিন্নতা দেখলে ঝগড়া করবেন না। আপনি যেই আলেমের ইলম ও তাকওয়ার ওপর আস্থা রাখেন, তাঁর সমাধান অনুযায়ী আমল করবেন, তবে সেমতে আমল করার জন্য অন্য কাউকে বাধ্য করবেন না। আর হজে যাওয়ার জন্য পরিচিত অথবা এলাকার দলনেতার (গ্রুপ লিডার) সঙ্গে আলাপ করতে পারেন।
বাংলাদেশ থেকে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়-দুভাবে হজ করতে যাওয়া যায়।
হজের জন্য প্রয়োজনীয় মালপত্র সংগ্রহ করা দরকার, যেমন-১· পিলগ্রিম পাস, টিকিট, ডলার কেনা, ২· পিলগ্রিম পাস, ভিসা, টাকা রাখার জন্য গলায় ঝোলানো ছোট ব্যাগ, ৩· ইহরামের কাপড় কমপক্ষে দুই সেট (প্রতি সেটে শরীরের নিচের অংশে পরার জন্য আড়াই হাত বহরের আড়াই গজ এক টুকরা কাপড় আর গায়ের চাদরের জন্য একই বহরের তিন গজ কাপড়। ইহরামের কাপড় হবে সাদা। সুতি হলে ভালো হয়), ৪· নরম ফিতাওয়ালা স্পঞ্জের স্যান্ডেল, ৫· ইহরাম পরার কাজে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন হলে কটিবন্ধনী (বেল্ট), ৬· গামছা, তোয়ালে, ৭· লুঙ্গি, গেঞ্জি, পায়জামা, পাঞ্জাবি-আপনি যে পোশাক পরবেন, ৮· সাবান, পেস্ট, ব্রাশ, মিসওয়াক, ৯· নখ কাটার যন্ত্র, সুই-সুতা, ১০· থালা, বাটি, গ্লাস, ১১· হজের বই, কোরআন শরিফ, ধর্মীয় পুস্তক, ১২· কাগজ-কলম, ১৩· শীতের কাপড় (মদিনায় ঠান্ডা পড়ে বেশি), ১৪· প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, চশমা ব্যবহার করলে অতিরিক্ত একটি চশমা (ভিড় বা অন্য কোনো কারণে ভেঙে গেলে ব্যবহারের জন্য), ১৫· বাংলাদেশি টাকা (দেশে ফেরার পর বিমানবন্দর থেকে বাড়ি ফেরার জন্য), ১৬· নারীদের জন্য বোরকা, ১৭· মালপত্র নেওয়ার জন্য ব্যাগ অথবা সুøটকেস (তালাচাবিসহ); ব্যাগের ওপর ইংরেজিতে নিজের নাম-ঠিকানা, ফোন নম্বর লিখতে হবে। এ ছাড়া আপনার প্রয়োজনীয় মালপত্র সঙ্গে নেবেন।
ঢাকার আশকোনায় অবস্থিত হাজি ক্যাম্পে টিকা দেওয়া, হজের প্রশিক্ষণ, বৈদেশিক মুদ্রা কেনাসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিস পাওয়া যায়।
হজ করতে যাচ্ছেন-যাত্রার শুরুতে নিজেকে এমনভাবে তৈরি করে নিন, যেন দেহ-মনে কোনো কষ্ট না থাকে। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে হজ হলো দৈহিক ও আর্থিক ইবাদত এবং শ্রমসাধ্য ব্যাপার।
আপনার মালপত্র হালকা রাখুন, কারণ আপনার মাল আপনাকেই বহন করতে হবে। আপনার সঙ্গীদের সম্মান করুন, তাঁদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকৃত ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আপনার দলে (গ্রুপে) দুর্বল বয়স্কদের প্রতি খেয়াল রাখবেন। সৌদি আরবে গিয়ে বিভিন্ন ওয়াক্তের নামাজ হারাম শরিফে জামাতে আদায় করার চেষ্টা করবেন (অনেকে বাসায় অথবা মহল্লার মসজিদে নামাজ আদায় করেন)। যাত্রার শুরুতে ভালো সফরসঙ্গী খুঁজে নেবেন, যাতে নামাজ পড়তে ও বাসায় চলাফেরায় একে অন্যের সাহায্য নিতে পারেন।
আপনি হজের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে যাচ্ছেন; সেখানকার মানুষ আরবি ভাষায় কথা বলে, রাস্তাঘাট আপনার অচেনা। কিন্তু হজযাত্রীদের খেদমত বা সেবা করার জন্য সৌদি আরব ও বাংলাদেশ সরকার নানা রকম ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।
ঢাকার হাজি ক্যাম্প
হাজি ক্যাম্পে যত দিন অবস্থান করবেন, আপনার মালপত্র খেয়াল রাখবেন। একদল সুযোগসন্ধানী লোক মালপত্র চুরি করে।
কোনো টিকা বা ভ্যাকসিন নেওয়া বাকি থাকলে অবশ্যই তা নিয়ে নিন।
বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে নিন।
জেনে নিন আপনার গন্তব্য ঢাকা থেকে মক্কায়, নাকি মদিনায়। যদি মদিনায় হয়, তাহলে এখন ইহরাম বাঁধা নয়; যখন মদিনা থেকে মক্কায় যাবেন, তখন ইহরাম পরতে হবে। বেশির ভাগ হজযাত্রী আগে মক্কা যান। যদি মক্কা যেতে হয়, তাহলে ঢাকা থেকে বিমানে ওঠার আগে ইহরাম বাঁধা ভালো। কারণ, জেদ্দা পৌঁছানোর আগেই ইয়ালামলাম মিকাত বা ইহরাম বাঁধার নির্দিষ্ট স্থান। বিমানে যদিও ইহরাম বাঁধার কথা বলা হয়, কিন্তু ওই সময় অনেকে ঘুমিয়ে থাকেন; আর বিমানে পোশাক পরিবর্তন করাটাও দৃষ্টিকটু। বিনা ইহরামে মিকাত পার হলে এ জন্য দম বা কাফফারা দিতে হবে। তদুপরি গুনাহ হবে।
ইহরাম ছাড়া মিকাত অতিক্রম নিষিদ্ধ। হজ বা উমরাহ পালনকারী ব্যক্তির জন্য বিনা ইহরামে যে স্থান অতিক্রম করা জায়েজ নয়, তা-ই হলো মিকাত। বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘরের সম্মানার্থে প্রত্যেককে নিজ নিজ মিকাত থেকে ইহরাম বাঁধতে হয় (মিকাত পাঁচটি-১· যুল হুলায়ফা বা বীরে আলীঃ মদিনাবাসী মক্কায় প্রবেশের মিকাত, ২· ইয়ালামলামঃ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থেকে জেদ্দা হয়ে মক্কা প্রবেশের মিকাত। ৩· আল-জুহফাঃ সিরিয়া, মিসর এবং সেদিক থেকে আগতদের জন্য মিকাত। ৪· কারনুল মানাজিল বা আসসায়েল আল-কাবিরঃ নাজদ থেকে আগতদের জন্য মিকাত এবং ৫· যাতু ইর্কঃ ইরাক থেকে আগতদের জন্য মিকাত)।
ঢাকা বিমানবন্দর
উড্ডয়নের সময় অনুযায়ী বিমানবন্দরে পৌঁছান। আপনার নাম-ঠিকানা লেখা ব্যাগ বা সুটকেসে কোনো পচনশীল খাবার রাখবেন না। বিমানবন্দরে লাগেজে যে মাল দেবেন, তা ঠিকমতো বাঁধা হয়েছে কি না, দেখে নেবেন। বিমানের কাউন্টারে মাল রেখে এর টোকেন দিলে তা যত্ন করে রাখবেন। কারণ, জেদ্দা বিমানবন্দরে ওই টোকেন দেখালে সেই ব্যাগ আপনাকে ফেরত দেবে। ইমিগ্রেশন, চেকিংয়ের পর নিজ মালপত্র যত্নে রাখুন।
বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া পরিচয়পত্র, পিলগ্রিম পাস, বিমানের টিকিট, টিকা দেওয়ার কার্ড, অন্য কাগজপত্র, টাকা, বিমানে পড়ার জন্য ধর্মীয় বই ইত্যাদি গলায় ঝোলানোর ব্যাগে যত্নে রাখুন।
সময়মতো বিমানে উঠে নির্ধারিত আসনে বসুন।
জেদ্দা বিমানবন্দর
মোয়াল্লেমের গাড়ি আপনাকে জেদ্দা থেকে মক্কায় যে বাড়িতে থাকবেন, সেখানে নামিয়ে দেবে। মোয়াল্লেমের নম্বর (আরবিতে লেখা) কব্জি বেল্ট দেওয়া হবে, তা হাতে পরে নেবেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া পরিচয়পত্র (যাতে পিলগ্রিম পাস নম্বর, নাম, ট্রাভেল এজেন্টের নাম ইত্যাদি থাকবে) গলায় ঝোলাবেন।
জেদ্দা থেকে মক্কায় পেঁৗছাতে দুই ঘণ্টা সময় লাগবে। চলার পথে তালবিয়া পড়ুন (লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক···)।
মক্কায় পৌঁছে
মক্কায় পৌঁছে আপনার থাকার জায়গায় মালপত্র রেখে ক্লান্ত থাকলে বিশ্রাম করুন। আর যদি নামাজের ওয়াক্ত হয়, নামাজ আদায় করুন। বিশ্রাম শেষে দলবদ্ধভাবে উমরাহর নিয়ত করে থাকলে উমরাহ পালন করুন।
মসজিদুল হারামে (কাবা শরিফ) অনেকগুলো প্রবেশপথ আছে; সব কটি দেখতে একই রকম। কিন্তু প্রতিটি প্রবেশপথে আরবি ও ইংরেজিতে ১, ২, ৩ নম্বর ও প্রবেশপথের নাম আছে, যেমন-বাদশা আবদুল আজিজ প্রবেশপথ। আপনি আগে থেকে ঠিক করবেন, কোন প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকবেন বা বের হবেন। আপনার সফরসঙ্গীকেও স্থান চিনিয়ে দিন। তিনি যদি হারিয়ে যান, তাহলে নির্দিষ্ট নম্বর গেটের সামনে থাকবেন। এতে ভেতরে ভিড়ে হারিয়ে গেলেও নির্দিষ্ট স্থানে এসে সঙ্গীকে খুঁজে পাবেন।
কাবা শরিফে স্যান্ডেল রাখার ক্ষেত্রে খুব সতর্ক থাকবেন, নির্দিষ্ট স্থানে জুতা রাখার জায়গায় রাখুন। এখানে-সেখানে জুতা রাখলে পরে আর খঁুজে পাবেন না। প্রতিটি জুতা রাখার র্যাকেও নম্বর দেওয়া আছে। এই নম্বর মনে রাখুন।
উমরাহর নিয়মকানুন আগে জেনে নেবেন, যেমন-সাতবার তাওয়াফ করা, জমজমের পানি পান করা, নামাজ আদায় করা, সাঈ করা (সাফা-মারওয়া পাহাড়ে দৌড়ানো-যদিও মসৃণ পথ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত), মাথা মুন্ডানো অথবা চুল ছোট করা-এসব কাজ ধারাবাহিকভাবে করা। ওয়াক্তীয় নামাজের সময় হলে যতটুকু হয়েছে ওই সময় নামাজ পড়ে আবার বাকিটুকু শেষ করা।
কাবা শরিফ
কাবা শরিফে প্রবেশ করার সময় বিসমিল্লাহ ও দরুদ শরিফ পড়ার পর আল্লাহুম মাফ তাহলি আব-ওয়া-বা রাহমাতিকা পড়বেন। মসজিদুল হারামে কোনো নারীর পাশে অথবা তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করা উচিত নয়।
কোনো দরজার সামনে নামাজ পড়া ঠিক নয়, এতে পথচারীর কষ্ট হয়।
হাজরে আসওয়াদে চুমু দেওয়া সুন্নত। তবে ভিড়ের কারণে না পারলে দূর থেকে চুমুর ইশারা করলেই চলবে। ভিড়ে অন্যকে কষ্ট দেওয়া যাবে না।
উমরাহ পালন ও হজ
উমরাহ
হিল (হারামের সীমানার বাইরে মিকাতের ভেতরের স্থান) থেকে অথবা মিকাত থেকে ইহরাম বেঁধে বায়তুল্লাহ শরিফ তাওয়াফ করা, সাফা-মারওয়া সাঈ করা এবং মাথার চুল ফেলে দেওয়া বা ছোট করাকে উমরাহ বলে।
হজ তিন প্রকার-তামাত্তু, কিরান ও ইফরাদ।
হজে তামাত্তু
হজের মাসসমূহে (শাওয়াল, জিলকদ, জিলহজ) উমরাহর নিয়তে ইহরাম করে, উমরাহ পালন করে, পরে হজের নিয়ত করে হজ পালন করাকে হজে তামাত্তু বলে।
হজে কিরান
হজের মাসসমূহে একই সঙ্গে হজ ও উমরাহ পালনের নিয়তে ইহরাম করে উমরাহ ও হজ করাকে হজে কিরান বলে।
হজে ইফরাদ
শুধু হজ পালনের উদ্দেশ্যে ইহরাম বেঁধে হজ সম্পাদনকে হজে ইফরাদ বলে।
তামাত্তু হজের নিয়ম
১· উমরাহর ইহরাম (ফরজ)
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সেরে গোসল বা অজু করে নিন।
মিকাত অতিক্রমের আগেই সেলাইবিহীন একটি সাদা কাপড় পরিধান করুন, আরেকটি গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ইহরামের নিয়তে দুই রাকাত নামাজ পড়ে নিন।
শুধু উমরাহর নিয়ত করে এক বা তিনবার তালবিয়া পড়ে নিন।
তালবিয়া হলো-লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা ওয়ান নিমাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক।
২· উমরার তাওয়াফ (ফরজ)
অজুর সঙ্গে ইজতিবাসহ তাওয়াফ করুন। ইহরামের চাদরকে ডান বগলের নিচের দিক থেকে পেঁচিয়ে এনে বাঁ কাঁধের ওপর রাখাকে ইজতিবা বলে।
হাজরে আসওয়াদকে সামনে রেখে তার বরাবর ডান পাশে দাঁড়ান (২০০৬ সাল থেকে মেঝেতে সাদা মার্বেল পাথর আর ডান পাশে সবুজ বাতি)। তারপর দাঁড়িয়ে তাওয়াফের নিয়ত করুন। তারপর ডানে গিয়ে এমনভাবে দাঁড়াবেন, যেন হাজরে আসওয়াদ পুরোপুরি আপনার সামনে থাকে। এরপর দুই হাত কাঁধ পর্যন্ত তুলে বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর, লা ইলাহা ইল্লাল লা-হু ওয়া লিল্লাহিল হামদ, ওয়াস সালাতু ওয়াস-সালামু আলা রাসুলিল্লাহ পড়ুন। পরে হাত ছেড়ে দিন এবং হাজরে আসওয়াদের দিকে হাত দিয়ে ইশারা করে হাতের তালুতে চুমু খেয়ে ডান দিকে চলতে থাকুন, যাতে পবিত্র কাবাঘর পূর্ণ বাঁয়ে থাকে। পুরুষের জন্য প্রথম তিন চক্করে রমল করা সুন্নত । রমল অর্থ বীরের মতো বুক ফুলিয়ে কাঁধ দুলিয়ে ঘন ঘন কদম রেখে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলা।
রুকনে ইয়ামানিকে সম্ভব হলে শুধু হাতে স্পর্শ করুন। রুকনে ইয়ামানিতে এলে রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়াকিনা আযাবান্নার, ওয়াদখিলনাল জান্নাতা মাআল আবরার, ইয়া আযিযু ইয়া গাফফার, ইয়া রাব্বাল আলামিন বলুন। চুমু খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। অতঃপর হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত এসে চক্কর পুরো করুন।
পুনরায় হাজরে আসওয়াদ বরাবর দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে হাতের তালুতে চুমু খেয়ে দ্বিতীয় চক্কর শুরু করুন। এভাবে সাত চক্করে তাওয়াফ শেষ করুন।
হাতে সাত দানার তসবি অথবা গণনাযন্ত্র রাখতে পারেন । তাহলে সাত চক্কর ভুল হবে না।
৩· তাওয়াফের দুই রাকাত নামাজ (ওয়াজিব)
মাকামে ইবরাহিমের পেছনে বা হারামের যেকোনো স্থানে তাওয়াফের নিয়তে (মাকরুহ সময় ছাড়া) দুই রাকাত নামাজ পড়ে দোয়া করুন। মনে রাখবেন, এটা দোয়া কবুলের সময়।
৪· উমরাহর সাঈ (ওয়াজিব)
সাফা পাহাড়ের কিছুটা ওপরে উঠে (এখন আর পাহাড় নেই, মেঝেতে মার্বেল পাথর, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত) কাবা শরিফের দিকে মুখ করে সাঈ-এর নিয়ত করে, দোয়ার মতো করে হাত তুলে তিনবার তাকবির বলে দোয়া করুন। তারপর মারওয়ার দিকে রওনা হয়ে দুই সবুজ দাগের মধ্যে (এটা সেই জায়গা, যেখানে হজরত হাজেরা (রা·) পানির জন্য দৌড়েছিলেন) একটু দ্রুত পথ চলে মারওয়ায় পেঁৗছালে এক চক্কর পূর্ণ হলো। মারওয়া পাহাড়ে উঠে কাবা শরিফের দিকে মুখ করে দোয়ার মতো করে হাত তুলে তাকবির পড়ুন এবং আগের মতো চলে সেখান থেকে সাফায় পেঁৗছালে দ্বিতীয় চক্কর পূর্ণ হলো এভাবে সপ্তম চক্করে মারওয়ায় গিয়ে সাঈ শেষ করে দোয়া করুন।
৫· হলক করা (ওয়াজিব)
পুরুষ হলে রাসুলুল্লাহ (সা·)-এর আদর্শের অনুসরণে সম্পূর্ণ মাথা মুণ্ডন করবেন, তবে মাথার চুল ছাঁটতেও পারেন। মহিলা হলে চুলের মাথা এক ইঞ্চি পরিমাণ কাটবেন।
এ পর্যন্ত উমরাহর কাজ শেষ।
হজের ইহরাম না বাঁধা পর্যন্ত ইহরামের আগের মতো সব কাজ করতে পারবেন।
৬· হজের ইহরাম (ফরজ)
হারাম শরিফ বা বাসা থেকে আগের নিয়মে শুধু হজের নিয়তে ইহরাম বেঁধে ৮ জিলহজ জোহরের আগেই মিনায় পৌঁছে যাবেন।
৭· মিনায় অবস্থান (সুন্নত)
৮ জিলহজ জোহর থেকে ৯ জিলহজ ফজরসহ মোট পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মিনায় আদায় করুন এবং এ সময়ে মিনায় অবস্থান করুন।
৮· আরাফাতের ময়দানে অবস্থান (ফরজ)
আরাফাতের ময়দানে অবস্থান হজের অন্যতম ফরজ।
৯ জিলহজ দুপুরের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করুন। এদিন নিজ তাঁবুতে জোহর ও আসরের নামাজ স্ব স্ব সময়ে আলাদাভাবে আদায় করুন। মুকিম হলে চার রাকাত পূর্ণ পড়ুন। মসজিদে নামিরায় উভয় নামাজ জামাতে পড়লে একসঙ্গে আদায় করতে পারেন। যদি ইমাম মুসাফির হন আর মসজিদে নামিরা যদি আপনার কাছ থেকে দূরে থাকে, তাহলে সেখানে অবস্থান করবেন। মাগরিবের নামাজ না পড়ে মুজদালিফার দিকে রওনা হোন।
৯· মুজদালিফায় অবস্থান (সুন্নত)
আরাফায় সূর্যাস্তের পর মুজদালিফায় গিয়ে এশার সময়ে মাগরিব ও এশা এক আজান ও এক ইকামতে একসঙ্গে আদায় করুন।
এখানেই রাত যাপন করুন (এটি সুন্নত) এবং ১০ জিলহজ ফজরের পর সূর্যোদয়ের আগে কিছু সময় মুজদালিফায় অবশ্যই অবস্থান করুন (এটি ওয়াজিব)। তবে দুর্বল (অপারগ) ও নারীদের বেলায় এটা অপরিহার্য নয়। রাতে ছোট ছোট ছোলার দানার মতো ৭০টি কঙ্কর সংগ্রহ করুন। মুজদালিফায় কঙ্কর খুব সহজেই পেয়ে যাবেন।
১০· কঙ্কর মারা (প্রথম দিন)
১০ জিলহজ ফজর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত শুধু বড় জামারাকে (বড় শয়তান) সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করুন (ওয়াজিব)। এ সময়ে সম্ভব না হলে এ রাতের শেষ পর্যন্ত কঙ্কর মারতে পারেন। দুর্বল ও নারীদের জন্য রাতেই কঙ্কর মারা উত্তম ও নিরাপদ।
কঙ্কর মারার স্থানে বাংলা ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়; তা মনোযোগ দিয়ে শুনুন এবং মেনে চলুন।
১১· কোরবানি করা (ওয়াজিব)
১০ জিলহজ কঙ্কর মারার পরই কেবল কোরবানি নিশ্চিত পন্থায় আদায় করুন।
কোরবানির পরেই কেবল রাসুলুল্লাহ (সা·)-এর আদর্শের অনুসরণে মাথা হলক করুন (ওয়াজিব)। তবে চুল ছোটও করতে পারেন।
খেয়াল রাখবেনঃ কঙ্কর মারা, কোরবানি করা ও চুল কাটার মধ্যে ধারাবাহিকতা জরুরি ও ওয়াজিব; অন্যথায় দম বা কাফফারা দিয়ে হজ শুদ্ধ করতে হবে। বর্তমানে এই সমস্যা সমাধানের সহজ উপায় হজে ইফরাদ করা। যেখানে কোরবানি নেই। হজের পরে উমরাহ করা যায়।
১২· তাওয়াফে জিয়ারত (ফরজ)
১২ জিলহজ সূর্যাস্তের আগেই তাওয়াফে জিয়ারত করে নিতে হবে। তা না হলে ১২ জিলহজের পরে তাওয়াফটি করে দম দিতে হবে। তবে নারীরা প্রাকৃতিক কারণে করতে না পারলে পবিত্র হওয়ার পরে করবেন।
১৩· কঙ্কর মারা (ওয়াজিব)
১১ ও ১২ জিলহজ কঙ্কর মারা (ওয়াজিব)। ১১-১২ জিলহজ দুপুর থেকে সময় আরম্ভ হয়। ভিড় এড়ানোর জন্য আসরের পর অথবা আপনার সুবিধাজনক সময়ে সাতটি করে কঙ্কর মারবেন-প্রথমে ছোট, মধ্যম, তারপর বড় শয়তানকে। ছোট জামারা থেকে শুরু করে বড় জামারায় শেষ করুন। সম্ভব না হলে শেষরাত পর্যন্ত মারতে পারেন। দুর্বল ও নারীদের জন্য রাতেই নিরাপদ।
১৪· মিনা ত্যাগ
১৩ জিলহজ মিনায় না থাকতে চাইলে ১২ জিলহজ সন্ধ্যার আগে অথবা সন্ধ্যার পর ভোর হওয়ার আগে মিনা ত্যাগ করুন। সূর্যাস্তের আগে মিনা ত্যাগ করতেই হবে-এটা ঠিক নয়। তবে সূর্যাস্তের আগে মিনা ত্যাগ করা উত্তম।
১৫· বিদায়ী তাওয়াফ (ওয়াজিব)
বাংলাদেশ থেকে আগত হজযাত্রীদের হজ শেষে বিদায়ী তাওয়াফ করতে হয় (ওয়াজিব)। তবে হজ শেষে যেকোনো নফল তাওয়াফই বিদায়ী তাওয়াফে পরিণত হয়ে যায়।
নারীদের মাসিকের কারণে বিদায়ী তাওয়াফ করতে না পারলে কোনো ক্ষতি নেই; দম বা কাফফারাও দিতে হয় না।
১৬· মিনায় অবস্থানরত দিনগুলোতে (১০, ১১ জিলহজ) মিনাতেই রাত যাপন করুন। আর ১২ তারিখ রাত যাপন করুন যদি ১৩ তারিখ রমি (কঙ্কর ছুড়ে মারা) শেষ করে ফিরতে চান (সুন্নত)।
কিরান হজের নিয়ম
কিরান হজের নিয়ম
১· ইহরাম বাঁধা (ফরজ)
জেদ্দা পৌঁছানোর আগে একই নিয়মে ইহরাম করার কাজ সমাপ্ত করুন। তবে তালবিয়ার আগেই হজ ও উমরাহ উভয়ের নিয়ত একসঙ্গে করুন।
২· উমরাহর তাওয়াফ (পূর্বে বর্ণিত) নিয়মে আদায় করুন (ওয়াজিব)।
৩· উমরাহর সাঈ করুন, তবে এরপর চুল ছাঁটবেন না; বরং ইহরামের সব বিধিবিধান মেনে চলুন (ওয়াজিব)।
৪· তাওয়াফে কুদুম করুন (সুন্নত)।
৫· এরপর সাঈ করুন, যদি এ সময় সাঈ করতে না পারা যায় তাওয়াফে জিয়ারতের পরে করুন (ওয়াজিব)।
৬· আট জিলহজ জোহর থেকে ৯ জিলহজ ফজর পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মিনাতে পড়ুন। এ সময়ে মিনাতে অবস্থান করুন (সুন্নত)।
৭· আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করুন (ফরজ)।
৮· নয় জিলহজ সূর্যাস্তের পর থেকে মুজদালিফায় অবস্থান এবং মাগরিব ও এশা একসঙ্গে এশার সময়ে আদায় করুন (সুন্নত)। তবে ১০ জিলহজ ফজরের পর কিছু সময় অবস্থান করুন (ওয়াজিব)।
৯· ওপরে বর্ণিত নিয়ম ও সময় অনুসারে ১০ জিলহজ কঙ্কর নিক্ষেপ করুন (ওয়াজিব)।
১০· কোরবানি করুন (ওয়াজিব)।
১১· মাথার চুল মুণ্ডন করে নিন (ওয়াজিব)। তবে চুল ছেঁটেও নিতে পারেন।
১২· তাওয়াফে জিয়ারত করুন (ফরজ) এবং সাঈ করে নিন, যদি তাওয়াফে কুদুমের পরে না করে থাকেন।
১৩· এগারো-বারো জিলহজ কঙ্কর নিক্ষেপ করুন (ওয়াজিব)। ১৩ জিলহজ কঙ্কর মারা রাসুলুল্লাহ (সা·)-এর আদর্শ।
১৪· মিনায় থাকাকালীন মিনাতেই রাত যাপন করুন (সুন্নত)।
১৫· মিকাতের বাইরে থেকে আগত হাজিরা বিদায়ী তাওয়াফ করুন (ওয়াজিব)।
ইফরাদ হজের নিয়ম ১· শুধু হজের নিয়তে (আগে বর্ণিত) ইহরাম বাঁধুন (ফরজ)।
২· মক্কা শরিফ পেঁৗছে তাওয়াফে কুদুম করুন (সুন্নত)।
৩· সাঈ করুন (ওয়াজিব)। এ সময়ে সম্ভব না হলে সাঈ তাওয়াফে জিয়ারতের পরে করুন।
৪· মিনায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও রাত যাপন করুন (সুন্নত)।
৫· আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করুন (ফরজ)।
৬· মুজদালিফায় অবস্থান করুন (সুন্নত)। তবে ১০ জিলহজ ফজরের পর কিছু সময় অবস্থান ওয়াজিব।
৭· ১০ জিলহজে জামারাতে সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করুন (ওয়াজিব)।
৮· যেহেতু এ হজে কোরবানি ওয়াজিব নয়, তাই কঙ্কর নিক্ষেপের পর মাথা হলক করে নিন; তবে চুল ছেঁটেও নিতে পারেন (ওয়াজিব)।
৯· তাওয়াফে জিয়ারত করুন (ফরজ) এবং যদি তাওয়াফে কুদুমের পর সাঈ না করে থাকেন, তাহলে সাঈ করে নিন (ওয়াজিব)।
১০· ১১-১২ জিলহজ আগে বর্ণিত নিয়ম ও সময়ে কঙ্কর নিক্ষেপ করুন (ওয়াজিব)।
১১· বদলি হজকারী ইফরাদ হজ করবেন।
ইহরাম, অন্যান্য পরামর্শ ও মক্কায় যা দ��
ইহরাম সম্পর্কে জরুরি বিষয়
যাঁরা সরাসরি বাংলাদেশ থেকে মক্কা শরিফ যাবেন, তাঁরা বাড়িতে, হাজি ক্যাম্পে বা বিমানে ইহরাম করে নেবেন। বাড়িতে বা হাজি ক্যাম্পে ইহরাম করে নেওয়া সহজ। ইহরাম ছাড়া যেন মিকাত অতিক্রম না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
যাঁরা মদিনা শরিফ যাবেন, তাঁরা মদিনা শরিফ থেকে মক্কা যাওয়ার সময় ইহরাম করবেন। কোনো নারী প্রাকৃতিক কারণে অপবিত্র হয়ে থাকলে ইহরামের প্রয়োজন হলে অজু-গোসল করে নামাজ ব্যতীত লাব্বাইক পড়ে ইহরাম করে নেবেন। তাওয়াফ ছাড়া হজ, উমরাহর সমস্ত কাজ নির্ধারিত নিয়মে আদায় করবেন।
তাওয়াফ ও সাঈ করার সময় বিশেষভাবে লক্ষণীয়
তাওয়াফের সময় অজু থাকা জরুরি। তবে সাঈ করার সময় অজু না থাকলেও সাঈ সম্পন্ন হয়ে যাবে।
হাজরে আসওয়াদে চুমু দেওয়া একটি সুন্নত। তা আদায় করতে গিয়ে লোকজনকে ধাক্কাধাক্কির মাধ্যমে কষ্ট দেওয়া বড় গুনাহ। তাই তাওয়াফকালে বেশি ভিড় দেখলে ইশারায় চুমু দেবেন।
সাঈ করার সময় সাফা থেকে মারওয়া কিংবা মারওয়া থেকে সাফা প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন চক্কর। এভাবে সাতটি চক্কর সম্পূর্ণ হলে একটি সাঈ পূর্ণ হবে।
অন্যান্য পরামর্শ
সৌদি আরবে অবস্থানকালে কোনো চাঁদা ওঠানো, সাহায্য চাওয়া, ভিক্ষা করা দণ্ডনীয় অপরাধ। সুতরাং এগুলো থেকে বিরত থাকুন।
সৌদি আরবে অবস্থানকালে ট্রাফিক আইন মেনে চলুন, সিগন্যাল পড়লে রাস্তা পার হোন। রাস্তা পার হওয়ার সময় অবশ্যই ডানে-বাঁয়ে দেখেশুনে সাবধানে পার হবেন। কখনো দৌড় দেবেন না।
কাবা শরিফ ও মসজিদে নববীর ভেতরে কিছুদূর পরপর পবিত্র কোরআন মজিদ রাখা আছে আর পাশে জমজম পানি (স্বাভাবিক ও ঠান্ডা) খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
মনে রাখবেন, মসজিদে নববী ও হারামের সীমানার মধ্যে ধূমপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
শরীরের কোনো স্থান কেটে গেলে অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম ব্যবহার করুন এবং ক্ষতস্থানটি প্লাস্টার কিংবা ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢেকে দিন।
হাঁচি কিংবা কাশি দেওয়ার সময় অবশ্যই আপনার মুখ ঢেকে নিন।
হজযাত্রীদের যাবতীয় তথ্য, দেশের পরিবার-পরিজনের কাছে ই-মেইলের মাধ্যমে সংবাদ পৌঁছানো যায়। হারানো হজযাত্রীদের খুঁজে পাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে বাংলাদেশ হজ মিশনে অবস্থিত হাতিল আইটি ইনফরমেশন সার্ভিসেস সাহায্য করে।
কোনো ধরনের অসুস্থতা কিংবা দুর্ঘটনায় পড়লে বাংলাদেশ হজ মিশনের মেডিকেল সদস্যদের (চিকিৎসক) সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
হজের সময় হজযাত্রীদের যেন কোনো রকম কষ্ট না হয়। আপনার ট্রাভেল এজেন্সি আপনাকে যথাযথ সুবিধাদি (দেশ থেকে আপনাকে থাকা, খাওয়াসহ অন্য যেসব সুবিধার কথা বলেছিল) না দিলে আপনি মক্কা ও মদিনার বাংলাদেশ হজ মিশনকে জানাতে পারেন। এতেও আপনি সন্তুষ্ট না থাকলে সৌদির ওজারাতুল হজকে (হজ মন্ত্রণালয়) লিখিত অভিযোগ করতে পারেন।
মক্কায় যা দেখবেন
মসজিদুল হারাম (কাবা শরিফ)।
সাফা ও মারওয়া।
মসজিদুল হারামের পূর্ব দিকে সাফা-মারওয়া পাহাড় পার হয়ে বাইরে গেলে পথের পাশে দোতলা একটি দালানে মক্কা লাইব্রেরি।
কয়েকটি বিশিষ্ট স্থানের পরিচয়
মাতাফঃ কাবাঘরের চারদিকে অবস্থিত তওয়াফের স্থানকে মাতাফ বা চত্বর বলা হয়।
হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথরঃ কাবা শরিফের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে লাগানো আছে একটি কালো পাথর, এটিই হাজরে আসওয়াদ। মুসলমানদের কাছে এই পাথর অতি মূল্যবান ও পবিত্র। তাদের কাছে এটি বেহেশতি পাথর, তাই এতে চুমু দেওয়ার ফজিলতও বেশি। হাজরে আসওয়াদ তাওয়াফ (কাবা শরিফ সাতবার চক্কর দেওয়া) শুরুর স্থান। প্রতিবার চক্কর দেওয়ার সময় এই হাজরে আসওয়াদে চুমু দিতে হয়। ভিড়ের কারণে না পারলে চুমুর ইশারা করলেও চলে-এটাই নিয়ম।
কাবাঘরঃ কাবাঘর প্রায় বর্গাকৃতির। এর র্দৈঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে আনুমানিক ৪৫ ও ৪০ ফুট। কাবা শরিফের দরজা একটি এবং দরজাটি কাবাঘরের পূর্ব দিকে অবস্থিত।
মিযাবে রহমতঃ বায়তুল্লাহর উত্তর দিকের ছাদে (হাতিমের মাঝ বরাবর) যে নালা বসানো আছে, তাকে মিযাবে রহমত বলা হয়। এই নালা দিয়ে ছাদের বৃষ্টির পানি পড়ে।
মাকামে ইবরাহীমঃ কাবা শরিফের পাশেই আছে ক্রিস্টালের একটি বাক্স, চারদিকে লোহার বেষ্টনী। ভেতরে বর্গাকৃতির একটি পাথর। পাথরটির দৈর্ঘø, প্রস্থ ও উচ্চতা সমান, প্রায় এক হাত। এ পাথরটিই মাকামে ইবরাহীম। মাকাম শব্দের একটি অর্থ হচ্ছে দাঁড়ানোর স্থান। অর্থাৎ হজরত ইবরাহীম (আ·) এর দাঁড়ানোর স্থান।
হাতিমঃ কাবাঘরের উত্তর দিকে অর্ধবৃত্তাকার মানুষ-সমান উঁচু প্রাচীরে ঘেরা একটি স্থান।
জান্নাতুল মুআল্লাঃ মসজিদুল হারামের পূর্ব দিকে মক্কা শরিফের বিখ্যাত কবরস্থান।
গারে হেরাঃ মক্কার সর্বাধিক উচ্চ পাহাড়ের একটি নির্জন স্থান। এখানে নবী করিম (সা·) ধ্যানমগ্ন থাকতেন এবং এখানেই সর্বপ্রথম ওহি নাজিল হয়।
গারে সাওরঃ মসজিদুল হারামের পশ্চিমে হিজরতের সময় এই প্রকাণ্ড সুউচ্চ পাহাড়ে রাসুলুল্লাহ (সা·) তিন দিন অবস্থান করেছিলেন।
জাবাল-ই-রহমতঃ আরাফাতের ময়দানে অবস্থিত। এ পাহাড়ে সর্বপ্রথম নবী হজরত আদম (আ·) এর দোয়া কবুল হয়। এখানে তিনি বিবি হাওয়া (আ·) এর সাক্ষাৎ পান। ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা·) বিদায় হজের খুতবাও এখান থেকেই দিয়েছিলেন।
জমজম কূপঃ দুনিয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের যত অনুপম নিদর্শন আছে, তার মধ্যে মক্কা শরিফে অবস্থিত জমজম কূপ অন্যতম। জমজম কূপের ইতিহাস কমবেশি সবারই জানা। এ কূপের পানি সর্বাধিক স্বচ্ছ, উৎকৃষ্ট, পবিত্র ও বরকতময়। এ পানি শুধু পিপাসাই মেটায় না; এতে ক্ষুধাও নিবৃত্ত হয়। এ সম্পর্কে রাসুলে করিম (সা·) বাণী প্রদান করেছেন, এ পানি শুধু পানীয় নয়; বরং খাদ্যের অংশ এবং এতে পুষ্টি রয়েছে।
হজ পালন করতে গিয়ে মক্কায় কিসওয়া তৈরির কারখানা দেখে আসতে পারেন। ট্যাক্সিতে কাবা শরিফ থেকে ১০ রিয়ালে পেঁৗছে যাবেন কিসওয়া। পাশেই মক্কা-মদিনার দুই হারাম শরিফে ব্যবহূত জাদুঘর। জাদুঘরে দেখতে পাবেন বিভিন্ন রকম কিসওয়া (কাবার গিলাফ)। সেখানে অনেক বাংলাদেশি চাকরি করেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে আরও অনেক কিছু জানতে পারবেন।
আরও কিছু করণীয়
আরও কিছু করণীয়
আরাফাতের ময়দানে অনেক প্রতিষ্ঠান বিনা মূল্যে খাবার, জুস, ফল ইত্যাদি দিয়ে থাকে। ওই সব খাবার আনতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি হয়, তাই সাবধান থাকবেন।
মুজদালিফায় রাতে থাকার জন্য প্লাস্টিকের পাটি পাওয়া যায়। মক্কায়ও কিনতে পারবেন।
আরাফাতের ময়দান থেকে যদি হেঁটে মুজদালিফায় আসেন, পথে টয়লেট সেরে নেবেন। কেননা মুজদালিফার টয়লেটে অনেক ভিড় লেগে যায়।
হজ মন্ত্রণালয় মিনার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে (যেখানে হজযাত্রীদের সহজে চোখে পড়ে) কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত ইলেকট্রনিক বিলবোর্ডে পৃথিবীর প্রায় ১৮টি ভাষায় বিভিন্ন জরুরি দিকনির্দেশনা ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বাংলায় প্রচার করে।
হজের বেশির ভাগ সময় হজযাত্রীদের মিনায় তাঁবুতে অবস্থান করতে হয়। তাই মিনাকে এক হিসেবে তাঁবুর শহর বলা যায়। চারদিকে তাঁবু আর তাঁবু-সব তাঁবু দেখতে একই রকম। মোয়াল্লেম নম্বর বা তাঁবু নম্বর জানা না থাকলে যে কেউই হারিয়ে যেতে পারেন। বিশেষ করে বাংলাদেশি হজযাত্রীদের বড় অংশ বৃদ্ধ বয়সে হজ করতে আসেন। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঙ্গে রাখেন না। অনেকে হারিয়ে ফেলেন গন্তব্য। বাংলাদেশি হজযাত্রী কিছু আছেন সচেতন, তাঁরা বাদে বাকিরা তাঁবু নম্বর মনে রাখতে পারেন না। সব তাঁবু দেখতে একই রকম হওয়ায় পথ হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশের পতাকা বা বাংলায় কথা বলা শুনে প্রবাসী বাংলাদেশি হজকর্মীরা তাঁদের গন্তব্যে পৌঁছে দেন।
এ সমস্যা এড়ানোর জন্য যে তাঁবুতে অবস্থান করেন, সেসব তাঁবু চিহ্নিত করে নিন।
মোয়াল্লেম অফিস থেকে তাঁবুর নম্বরসহ কার্ড দেওয়া হয়; তা যত্নে রাখুন। বাইরে বের হওয়ার সময় সঙ্গে রাখুন।
হজযাত্রী সচেতন থাকলে হারিয়ে যাওয়ার কোনো ভয় নেই। অনেক বাংলাদেশি হারিয়ে যাওয়ার কারণে হজের আহকাম বা নিয়ম-কানুন ঠিকমতো পালন করতে পারেন না।
মক্কা-মদিনায় প্রচুর বাংলাদেশি হোটেল আছে। মক্কার হোটেলগুলোর নাম ঢাকা, এশিয়া, চট্টগ্রাম, জমজম ইত্যাদি। এসব হোটেলে ভাত, মাছ, মাংস, সবজি, ডাল-সবই পাওয়া যায়। হোটেল থেকে পার্সেলে বাড়িতে খাবার নিয়ে দুজন অনায়াসে খেতে পারেন।
মক্কা-মদিনায় প্রচুর ফলমূল ও ফলের রস পাওয়া যায়। এগুলো কিনে খেতে পারেন।
মক্কা-মদিনায় অনেক বাংলাদেশি কাজ করেন, তাই ভাষাগত কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কেনাকাটার সময় দরদাম করে কিনবেন।
হজের সময় প্রচুর হাঁটাচলা করতে হয়, পকেটে টাকা থাকলেও যানবাহন পাওয়া যায় না।
মিনায় চুল কাটার লোক পাওয়া যায়। নিজেরা নিজেদের চুল কাটবেন না, এতে মাথা কেটে যেতে পারে।
মিনায় কোনো সমস্যা হলে হজযাত্রীদের সেবা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ হজ মিশনের তাঁবুতে যোগাযোগ করবেন।
মক্কা-মদিনা থেকে বাংলাদেশে কম খরচে ফোন করা যায় (কোনো বাংলাদেশিকে বললে দেখিয়ে দেবেন)। সৌদি আরবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে চাইলে সঙ্গে সেট নিয়ে যাবেন, ওখানে (হজ প্যাকেজ) মোবাইল সিম কিনতে পাওয়া যায়।
হজের আগে ও পরে আরও উমরাহ করতে চাইলে তানঈম মসজিদ-এ (উমরাহ মসজিদে) গিয়ে উমরাহর নিয়ত করে আসা যায়। কাবা শরিফের বাইরে বাস অথবা ট্যাক্সিতে দুই রিয়ালে উমরাহ মসজিদে যাওয়া যায়।
মক্কায় কাবা শরিফ ছাড়াও জাবাল-ই-রহমত (আরাফাতের ময়দানে অবস্থিত), জাবাল-ই-নূর (যেখানে রাসুলুল্লাহ (সা·) ধ্যান করতেন; এখানে পবিত্র কোরআনের আয়াত নাজিল হয়), মিনায় আল-খায়েফ মসজিদ, নামিরা মসজিদ, আরাফাতের ময়দান, মুজদালিফা, জাবাল-ই-সাওর প্রভৃতি ঐতিহাসিক স্থানে ঘুরে আসা যায়।
জিয়ারতে মদিনা মুনাওয়ারা
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা·) এর জিয়ারতে মোবারক সর্বসম্মতভাবে শ্রেষ্ঠ সওয়াবের কাজ। মর্যাদা ও উন্নতি লাভের জন্য এর চেয়ে শ্রেয়তর ও বড় মাধ্যম আর নেই। কোনো কোনো আলেম একে ওয়াজিব বলে গণ্য করেছেন। বড়ই সৌভাগ্যবান সেই ব্যক্তি, যে এই মোবারকময় জিয়ারতে মদিনার তাওফিক লাভ করেন।
নবী করিম (সা·) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি হজ সম্পন্ন করল এবং আমার ইন্তেকালের পর কবর জিয়ারত করল; সে যেন জীবদ্দশায়ই আমার জিয়ারত করল। (মিশকাত)
রাসুলুল্লাহ (সা·) আরও ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আমার কবর জিয়ারত করল, আমার ওপর তার জন্য শাফায়াত (সুপারিশ) ওয়াজিব হয়ে গেল। (ফাতহুল কাদীর)
এ জন্য সংগতিপূর্ণ প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানের এই সৌভাগ্য অর্জন করা উচিত।
মসজিদে নববীতে এক ওয়াক্ত নামাজের সওয়াব সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিম শরিফের বর্ণনা অনুযায়ী অন্য জায়গার এক হাজার ওয়াক্তের চেয়েও বেশি।
ইবনে মাজাহ্র এক রেওয়ায়াতে একে ৫০ হাজার ওয়াক্ত নামাজের সমান বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র·) হজরত আনাস (রা·) থেকে বর্ণনা করেছেনঃ নবী করিম (সা·) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আমার মসজিদে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে এবং একটি নামাজও বাদ দেবে না, তার জন্য দোজখ থেকে মুক্তির ছাড়পত্র লিখে দেওয়া হবে। এ জন্য মসজিদে নববীতে জামাতে নামাজ পড়ার বিশেষ চেষ্টা রাখতে হবে। মসজিদে নববীতে ইবাদত করুন। কোরআন শরিফও তিলাওয়াত করতে পারেন।
মদিনার মিসকিন, প্রতিবেশী এবং স্থায়ী বাসিন্দাদের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখুন। সাধ্য অনুযায়ী দান-খয়রাত করুন। সেখানে থেকে কেনাকাটার সময়ও তাদের সাহায্যের নিয়ত করুন; এতে অনেক সওয়াব পাবেন।
মদিনা থেকে যদি মক্কায় আসেন, তাহলে ইহরামের কাপড় সঙ্গে নিতে হবে।
রাসুলে করিম (সা·)-এর রওজা জিয়ারত
রাসুলে করিম (সা·)-এর রওজা জিয়ারত জিয়ারত ও নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে মদিনায় যাওয়া সুন্নত। মসজিদে নববীতে নামাজ পড়ায় ফজিলত বেশি।
মসজিদে নববীতে জিয়ারতের জন্য ইহরাম বাঁধতে বা তালবিয়া পড়তে হয় না। তবে মদিনা থেকে যদি মক্কায় আবার আসতে হয়, তাহলে মিকাত বীর আলী পার হলে ইহরাম বেঁধে আসতে হবে।
রওজায়ে জান্নাত বা রিয়াজুল জান্নাহ
হুজরায়ে মোবারক ও মিম্বার শরিফের মাঝখানের জায়গাটি রওজায়ে জান্নাত বা রিয়াজুল জান্নাহ বা বেহেশতের বাগান নামে পরিচিত। এ স্থানটির বিশেষ ফজিলত রয়েছে। এখানে নামাজ পড়ারও বিশেষ ফজিলত আছে।
মসজিদে নববীতে কয়েকটি ঐতিহাসিক স্তম্ভ
উস্তুওয়ানা হান্নানা (সুবাস স্তম্ভ) মিম্বারে নববীর ডান পাশে খেজুরগাছের গুঁড়ির স্থানে নির্মিত স্তম্ভটি। নবী করিম (সা·) মিম্বার স্থানান্তরের সময় এ গুঁড়িটি উঁচু স্বরে কেঁদেছিলেন।
উস্তুওয়ানা সারীরঃ এখানে রাসুলুল্লাহ (সা·) ইতিকাফ করতেন এবং রাতে আরামের জন্য তাঁর বিছানা এখানে স্থাপন করা হতো। এ স্তম্ভটি হুজরা শরিফের পশ্চিম পাশে জালি মোবারকের সঙ্গে রয়েছে।
উস্তুওয়ানা উফুদঃ বাইরে থেকে আগত প্রতিনিধিদল এখানে বসে রাসুলুল্লাহ (সা·)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করতেন এবং এখানে বসেই কথা বলতেন। এ স্তম্ভটিও জালি মোবারকের সঙ্গে রয়েছে।
উস্তুওয়ানা আয়েশা (আয়েশা স্তম্ভ)- নবী করিম (সা·) বলেছেন, আমার মসজিদে এমন একটি জায়গা রয়েছে, লোকজন যদি সেখানে নামাজ পড়ার ফজিলত জানত, তাহলে সেখানে স্থান পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করত। স্থানটি চিহ্নিত করার জন্য সাহাবায়ে কিরাম চেষ্টা করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা·)-এর ইন্তেকালের পর হজরত আয়েশা (রা·) তাঁর ভাগ্নে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইরকে (রা·) সে জায়গাটি চিনিয়ে দেন। এটিই সেই স্তম্ভ। এই স্তম্ভটি উস্তুওয়ানা উফুদের পশ্চিম পাশে রওজায়ে জান্নাতের ভেতর।
উস্তুওয়ানা আবু লুবাবা (তওবা স্তম্ভ)- হজরত আবু লুবাবা (রা·) থেকে একটি ভুল সংঘটিত হওয়ার পর তিনি নিজেকে এই স্তম্ভের সঙ্গে বেঁধে বলেছিলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত হুজুরে পাক (সা·) নিজে না খুলে দেবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি এর সঙ্গে বাঁধা থাকব। নবী করিম (সা·) বলেছিলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আমাকে আল্লাহ আদেশ না করবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত খুলব না। এভাবে দীর্ঘ ৫০ দিন পর হজরত আবু লুবাবা (রা·)-এর তওবা কবুল হলো। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা·) নিজ হাতে তাঁর বাঁধন খুলে দিলেন। এটি উস্তুওয়ানা উফুদের পশ্চিম পাশে রওজায়ে জান্নাতের ভেতর অবস্থিত।
উস্তুওয়ানা জিবরাইলঃ ফেরেশতা হজরত জিবরাইল (আ·) যখনই হজরত দেহইয়া কালবী (রা·)-এর আকৃতি ধারণ করে ওহি নিয়ে আসতেন, তখন অধিকাংশ সময় তাঁকে এখানেই উপবিষ্ট দেখা যেত।
মিহরাবে নববীঃ মাকরুহ ওয়াক্ত না হলে কাউকে কষ্ট না দিয়ে এখানে নফল নামাজ পড়ুন। মিহরাবের ডানে রাসুলুল্লাহ (সা·)-এর দাঁড়ানোর জায়গা।
নবী করিম (সা·)-এর রওজা মোবারক
সালাম পেশ করার নিয়ম
কিবলার দিকে পিঠ করে নবী করিম (সা·)-এর চেহারা মোবারককে সামনে রেখে এমনভাবে দাঁড়াতে হবে, যেন রাসুলুল্লাহ (সা·) আপনার সামনে। এ সময় পৃথিবীর যাবতীয় চিন্তাভাবনা থেকে দিলকে মুক্ত করে একমন, একদিল হয়ে অত্যন্ত আদবের সঙ্গে সালাম পেশ করতে হবে। এ রকম খেয়াল করতে হবে যে, নবী করিম (সা·) কবর মোবারকে কিবলার দিকে মুখ করে আরাম করছেন এবং সালাম-কালাম শ্রবণ করছেন।
মদিনার প্রাণকেন্দ্র মসজিদে নববী
ইসলামে ফজিলত লাভের উদ্দেশ্যে কেবল তিন মসজিদে ভ্রমণ করার অনুমোদন আছে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো মক্কা মুকাররমা বা কাবা শরিফ (সৌদি আরব)। দ্বিতীয়টি হচ্ছে মসজিদ আল-আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাসঃ ইসলামের প্রথম কিবলা মসজিদ (ফিলিস্তিন)। তৃতীয়টি হলো মদিনা আল-মুনাওয়ারার মসজিদে নববীঃ নবীজিকে যেখানে চির শয়নে শায়িত করা হয়েছে। মদিনা নবীর শহর, একে আরবিতে বলা হয় মদিনাতুন নবী। আর মদিনার প্রাণকেন্দ্র হলো মসজিদে নববী। মদিনার ৯৫টি নাম রয়েছে, যেমন দারুস সালাম (শান্তির ঘর)। তা ছাড়া মদিনার ৯৯টি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা·) মদিনার বরকতের জন্য দোয়া করেছেন, একে হারাম বা সম্মানিত ঘোষণা করেছেন। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছেঃ ঘর থেকে অজু করে মসজিদে কুবায় গিয়ে নামাজ পড়লে একটি উমরাহর সওয়াব পাওয়া যায়।
মসজিদে নববীর ভেতরে স্বয়ংক্রিয় ছাদের ব্যবস্থা আছে, যা দিনের বেলা সুইচের মাধ্যমে খুলে দেওয়া হয় আর রাতে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পাশেই জান্নাতে বাকি গোরস্তান। এখানে ফাতেমা (রা·), মা হালিমা ও হজরত ওসমান (রা·)সহ অগণিত সাহাবা (রা·)-এর কবর রয়েছে। এর একপাশে নতুন কবর হচ্ছে প্রত্যহ। এখানে শুধু একটি পাথরের খণ্ড দিয়ে চিহ্নিত করা আছে একেকটি কবর। কেউ কেউ একে বাকি গোরস্তান বলে সম্বোধন করেন।
মসজিদে নববীর উত্তর দিকের গেট দিয়ে বেরিয়েই সাহাবাদের মসজিদ। পাশাপাশি দুটি এবং একটি একটু দূরে একই ডিজাইনে করা তিনটি মসজিদ। এগুলোকে সাহাবা মসজিদ বলা হয়।
মসজিদে নববীতে নারীদের জন্য আলাদা নামাজ পড়ার জায়গা আছে।
ভেতরে কিছুদূর পরপর পবিত্র কোরআন মজিদ রাখা আছে, আর পাশে আছে জমজম পানি খাওয়ার ব্যবস্থা।
রাসুলুল্লাহ (সা·)-এর রওজা মোবারক
উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা·) এর কক্ষেই রাসুলুল্লাহ (সা·)-এর ওফাত হয় এবং সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। মসজিদ সম্প্রসারণ করার পর বর্তমানে তাঁর কবর মসজিদে নববীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। রাসুলে করিম (সা·)-এর রওজার ডানদিকে খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা·) ও খলিফা হজরত ওমর ফারুক (রা·)-এর কবর। মসজিদে নববীতে সালাত আদায় ও দোয়া করার উদ্দেশ্যেই মদিনায় গমন এবং সালাত আদায় করে রাসুলুল্লাহ (সা·)-এর রওজা শরিফ জিয়ারত করা ও সালাম পৌঁছানোর ইচ্ছা প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানের থাকে।
মদিনার কয়েকটি ঐতিহাসিক মসজিদ
মদিনায় অনেক ঐতিহাসিক মসজিদ রয়েছে।
মসজিদে মিকাতঃ মদিনা থেকে মক্কা যাওয়ার পথে মসজিদে নববী থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে এ মসজিদটি অবস্থিত। ঐতিহাসিক আকীক উপত্যকার পশ্চিম পাশে মসজিদটি রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা·) হজ বা উমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা যাওয়ার সময় এখানকার একটি গাছের নিচে অবতরণ করতেন এবং সেখানে সালাত আদায় করে উমরাহ অথবা হজের ইহরাম বাঁধতেন। এ কারণেই মসজিদটিকে শাজারাহ্ বলা হয়। মদিনাবাসীর মিকাত বলে এ মসজিদটি মসজিদে মিকাত নামে পরিচিত।
মসজিদে জুমুআঃ রাসুলুল্লাহ (সা·) হিজরতের সময় কুবার অদূরে রানুনা উপত্যকায় একশ সাহাবাকে নিয়ে মসজিদে জুমুআর স্থানে প্রথম জুমুআর সালাত আদায় করেন।
মসজিদে গামামাহঃ এ মসজিদকে মোসাল্লাহও বলা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা·) প্রথম ঈদের সালাত ও শেষ জীবনের ঈদের সালাতগুলো মসজিদে গামামাহর স্থানে আদায় করেন। এ স্থানে রাসুলুল্লাহ (সা·) বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়েছেন বলে একে মসজিদে গামামাহ বলা হয়। এটি মসজিদে নববীর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত।
মসজিদে আবু বকর (রা·)- এটি মসজিদে গামামাহর উত্তরে অবস্থিত। হজরত আবু বকর (রা·) খলিফা থাকাকালে এ মসজিদে ঈদের সালাত পড়ান। তাই এটি মসজিদে আবু বকর (রা·) হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
কিবলাতাঈন মসজিদঃ এ মসজিদে একই নামাজ দুই কিবলামুখী হয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। নামাজ পড়তে দাঁড়িয়ে ওহি পাওয়ার পর আল-আকসা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নামাজের মাঝখানে মক্কামুখী হয়ে পরবর্তী অংশ সম্পন্ন করা হয়। এ জন্য এ মসজিদের নাম কিবলাতাঈন (দুই কিবলা মসজিদ) রাখা হয়। মসজিদের ভেতরে মূল পুরোনো মসজিদের অংশ অক্ষত রেখে চারদিকে দালান করে মসজিদ বাড়ানো হয়েছে।
মসজিদে কুবাঃ হজরত মুহাম্মদ (সা·) মদিনায় আগমন করে প্রথম শহরের প্রবেশদ্বারে কুবায় নামাজ পড়েন। পরে এখানে মসজিদ গড়ে ওঠে। কুবায় এসে আপনি দুই রাকাত নামাজ পড়তে পারেন। মদিনায় আরও বেশি সময় পেলে দেখে আসতে পারেন খাইবার।
সময় পেলে দেখতে পারেন মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়, কোরআন ছাপা প্রকল্প। এখানে প্রতি মিনিটে ৫০০ কোরআন ছাপা হয়।
ওহুদঃ ইসলামের দ্বিতীয় যুদ্ধ এটি। দুই মাথাওয়ালা একটি পাহাড়, দুই মাথার মাঝখানে একটু নিচুমতো-এটাই ওহুদের পাহাড়। তৃতীয় হিজরির শাওয়াল মাসে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
মসজিদে কুবা, কিবলাতাঈন, ওহুদ পাহাড়, খন্দকের পাহাড় প্রভৃতি দেখার জন্য মসজিদে নববীর বাইরে প্রবেশপথের কাছে ট্যাক্সিচালকেরা প্যাকেজের ব্যবস্থা করেন। খরচ মাত্র ১০ রিয়াল।
ইহরাম অবস্থায় যেসব কাজ নিষিদ্ধ
ইহরাম অবস্থায় যেসব কাজ নিষিদ্ধ * সহবাস এবং ওই বিষয়ে কোনো আলোচনা করা যাবে না।
* পুরুষদের জন্য শরীরের আকৃতি নেয় এমন কোনো সেলাই করা জামা, পায়জামা ইত্যাদি পরা বৈধ নয়।
* কথা ও কাজে কাউকে কষ্ট দেওয়া যাবে না।
* পুরুষদের ক্ষেত্রে মাথা বা মুখ ঢাকা যাবে না; এমনকি টুপিও পরা যাবে না।
* মহিলাদের মাথায় অবশ্যই কাপড় রাখতে হবে, তবে মুখমণ্ডল স্পর্শ করে এমন কাপড় পরবেন না।
* নখ, চুল, দাড়ি-গোঁফ ও শরীরের একটি পশমও কাটা বা ছেঁড়া যাবে না।
* কোনো ধরনের সুগন্ধি লাগানো যাবে না।
* কোনো ধরনের শিকার করা যাবে না।
* ক্ষতিকারক সকল প্রাণী মারা যাবে। ক্ষতি করে না এমন কোনো প্রাণী মারা যাবে না।
দোয়া কবুলের জায়গা
পবিত্র মক্কায় কাবা শরিফের বিভিন্ন জায়গায় দোয়া কবুল হয়ে থাকে। সেসব জায়গায় খুব আদব, ভক্তি ও বিনয়ের সঙ্গে খাস দিলে দোয়া করা দরকার। দুনিয়ার যাবতীয় জায়েজ নেক মাকসুদের জন্য দোয়া করা উচিত।
* মাতাফ-তাওয়াফ করার স্থানকে মাতাফ বলে।
* মুলতাযাম-হাজরে আসওয়াদ থেকে বায়তুল্লাহর দরজা পর্যন্ত স্থানে।
* হাতিমের মধ্যে।
* মিযাবে রহমতের মধ্যে।
* কাবাঘরের ভেতরে।
* জমজম কূপের কাছে (যদিও কূপ এখন বেজমেন্টের নিচে, চাইলেও এখন দেখা যায় না)।
* মাকামে ইবরাহীমের কাছে।
* সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের ওপর।
* সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝখানে।
* বায়তুল্লাহর দিকে যখন নজর পড়ে।
* রুকনে ইয়ামানি ও হাজরে আসওয়াদের মাঝখানে।
* আরাফাতের ময়দানে।
* মুজদালিফার ময়দানে।
* মিনার ময়দানে এবং মিনার মসজিদে খায়েফে।
* কঙ্কর মারার স্থানে।
সালাম পাঠ করুন
রাসুলুল্লাহ (সা·)-এর সম্মান ও মর্যাদার কথা স্মরণ করে মধ্যম আওয়াজে সালাম পেশ করতে হবে। সালাম এভাবে পাঠ করুন-
আসসালাতু আসসালামু আলাইকা আইয়ুহান্নবী ওয়া রাহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহু
আসসালাতু ওয়াস্ সালামু আলাইকা ইয়া রাসুলুল্লাহ
আসসালাতু ওয়াস্ সালামু আলাইকা ইয়া নাবীআল্লাহ
আসসালাতু ওয়াস্ সালামু আলাইকা ইয়া হাবীবাল্লাহ
আসসালাতু ওয়াস্ সালামু আলাইকা ইয়া খায়রা খালকিল্লাহ
আসসালাতু ওয়াস্ সালামু আলাইকা ইয়া সায়্যিদাল মুরসালীন
আসসালাতু ওয়াস্ সালামু আলাইকা ইয়া খাতামান নাবীয়্যীন
আসসালাতু ওয়াস্ সালামু আলাইকা ইয়া রাহমাতাল্লিল আলামীন
আসসালাতু ওয়াস্ সালামু আলাইকা ইয়া শাফীয়াল মুযনিবীন।
তারপর ডানদিকে সরে গিয়ে হজরত আবু বকর (রা·)-এর চেহারা মোবারক বরাবর দাঁড়িয়ে পাঠ করুন-
আসসালামু আলাইকা ইয়া খালিফাতি রাসুলুল্লাহি আবু বকর (রা·)।
তারপর ডানদিকে সরে গিয়ে হজরত ওমর (রা·)-এর চেহারা মোবারক বরাবর দাঁড়িয়ে পাঠ করুন-
আসসালামু আলাইকা ইয়া আমীরাল মুমিনীন ওমর ফারুক (রা·)।
একনজরে হজ
তামাত্তু কিরান ইফরাদ
১· উমরার ইহরাম (ফরজ) হজ ও উমরার ইহরাম (ফরজ) হজের ইহরাম (ফরজ)
২· উমরার তাওয়াফ (ফরজ) উমরার তাওয়াফ (ফরজ) -
৩· উমরার সাঈ (ওয়াজিব) উমরার সাঈ (ওয়াজিব) -
৪· – তাওয়াফে কুদুম (সুন্নাত) তাওয়াফে কুদুম (সুন্নাত)
৫· – সাঈ (ওয়াজিব) -
৬· মাথা মুণ্ডন করা বা চুল – -
খাটো করা (ওয়াজিব)
৮ জিলহজ জোহরের নামাজের পূর্ব থেকে
৭· হজের ইহরাম (ফরজ) – -
৮· মিনায় রাতযাপন (সুন্নত) মিনায় রাতযাপন (সুন্নাত) মিনায় রাতযাপন (সুন্নাত)
৯· জোহর, আসর, মাগরিব, জোহর, আসর, মাগরিব, এশা, জোহর, আসর, মাগরিব, এশা,
এশা, ফজর নামাজ মিনায় ফজর নামাজ মিনায় পড়া ফজর নামাজ মিনায় পড়া
পড়া (মুস্তাহাব) (মুস্তাহাব) (মুস্তাহাব)
৯ জিলহজ সূর্যোদয়ের পর
১০· আরাফাতে অবস্থান (ফরজ) আরাফাতে অবস্থান (ফরজ) আরাফাতে অবস্থান (ফরজ)
আরাফার দিন সূর্যোস্তের পর মুজদালিফার দিকে রওনা
১১· মুজদালিফায় অবস্থান মুজদালিফায় অবস্থান মুজদালিফায় অবস্থান
(ওয়াজিব) (ওয়াজিব) (ওয়াজিব)
১০ জিলহজ
১২· বড় জামরাকে (শয়তান) বড় জামরাকে (শয়তান) বড় জামরাকে (শয়তান)
কঙ্কর মারা (ওয়াজিব) কঙ্কর মারা (ওয়াজিব) কঙ্কর মারা (ওয়াজিব)
১৩· কুরবানি করা (ওয়াজিব) কুরবানি করা (ওয়াজিব) -
১৪· মাথার চুল পুরো ফেলে দেওয়া মাথার চুল পুরো ফেলে দেওয়া মাথার চুল পুরো ফেলে দেওয়া
বা চুল খাটো করা (ওয়াজিব) বা চুল খাটো করা (ওয়াজিব) বা চুল খাটো করা (ওয়াজিব)
শারীরিক সম্পর্ক ছাড়া সবকিছু হালাল হবে
১৫· তাওয়াফ (ইফাজা বা তাওয়াফ (ইফাজা বা জিয়ারত) তাওয়াফ (ইফাজা বা
জিয়ারত) (ফরজ) (ফরজ) জিয়ারত) (ফরজ)
সম্পূর্ণ হালাল হয়ে যাবে
১৬· সাঈ (ওয়াজিব) – সাঈ (ওয়াজিব)
১১-১২ জিলহজ জোহরের সময় থেকে শুরু করে কঙ্কর মারা
১৭· ১১-১২ তারিখ ছোট, মধ্যম, ১১-১২ তারিখ ছোট, মধ্যম, ১১-১২ তারিখ ছোট, মধ্যম,
বড় শয়তানকে পাথর মারা বড় শয়তানকে পাথর বড় শয়তানকে পাথর
(ওয়াজিব) মারা (ওয়াজিব) মারা (ওয়াজিব)
১৮· বিদায়ী তাওয়াফ (ওয়াজিব) বিদায়ী তাওয়াফ (ওয়াজিব) বিদায়ী তাওয়াফ (ওয়াজিব)
উল্লেখ্য, ইফরাদ ও কেরান হজকারী তাওয়াফে কুদুম করবেন। তাওয়াফে কুদুমের সঙ্গে সাঈ করলে তাওয়াফে জিয়ারতের পর আর সাঈ করতে হবে না।তবে কেরান হজকারীদের জন্যতাওয়াফে কুদুমের সঙ্গে সাঈ করা, ইফরাদ হজকারীদের জন্য তাওয়াফে জিয়ারতের সঙ্গে সাঈ করা উত্তম। তামাত্তুকারীরা হজের ইহরামের পরে নফল তাওয়াফ করে সাঈ করে নিলে তাওয়াফে জিয়ারত বা ইফাজের সময় আর সাঈ করতে হবে না।
প্রিন্ট Share Email Facebook
সম্পাদনা
মুফতি মুহাম্মদ মুহিববুল্লাহিল বাকী নদভী
পেশ ইমাম, জাতীয়মসজিদ বায়তুল মোকাররম, ঢাকা।
সহযোগিতায়
ড· মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
সহকারী অধ্যাপক, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়
সংকলনে
আলহাজ ফেরদৌস ফয়সাল
কৃতজ্ঞতায়ঃ ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা, ঢাকা, বাংলাদেশ।